ড. ইউনূস ও হাসিনার কান্নার মধ্যে পার্থক্যটা কি ?

প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২৫ ০৭:২৪ অপরাহ্ণ
প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২৫ ০৭:২৪ অপরাহ্ণ

সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে কেঁদেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস। তার সেই কান্না নিয়ে নিজের অভিমত প্রকাশ করেছেন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট সাইয়েদ আবদুল্লাহ।

তিনি লিখেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস আজকে ইনভেস্টমেন্ট সামিটে লম্বা একটা বক্তব্য দিয়েছেন। সেখানে কথা

বলতে বলতে একটা জায়গায় গিয়ে অনেকবেশি আবেগতাড়িত হয়ে পড়লেন— ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের কথা বলার সময়।

না, এই কান্না বা আবেগ কোন লোকদেখানো মুখস্থ গৎবাঁধা ‘স্বজন হারানোর বেদনা’ নয়, একদম মনের ভেতর থেকে দাগ কাটা আবেগ, নিজের দেশকে নিয়ে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।

১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষের ইতিহাস নিয়ে খুব বেশি টেক্সট নাই আমাদের। ইতিহাস হিসাবে আলোচিত হয় খুবই কম। এইযে ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষের দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখা হয়, এর পেছনে রাজনৈতিক মোটিভ ছিলো আওয়ামী লিগের।

কারণ প্রাকৃতিক কিছু দুর্যোগের পাশাপাশি ওই দুর্ভিক্ষের সবচেয়ে বড় কারণ ছিলো তৎকালীন লিগ সরকারের অব্যবস্থাপনা এবং প্রশাসনিক লুটপাট।

বহু বহু মানুষ মারা যায় সেই দুর্ভিক্ষে, কয়েক লক্ষ। আর সেই দুর্ভিক্ষের প্রভাব পড়ে দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর ওপর। ওইসময়ের পুরোনো পত্রিকার আর্কাইভ ঘাঁটলে মানুষের সেই দুর্বিষহ পরিস্থিতির বর্ণনা পাওয়া যায়। উত্তরবঙ্গ থেকে শুরু করে অন্যান্য এলাকারও বিভিন্ন জেলায় প্রতিদিনই মানুষ মারা যেতো না খেতে পেরে।

দেশে একদিকে চলছিলো স্মরণকালের সবচেয়ে বড় দুর্ভিক্ষ, অন্যদিকে চলছিলো সরকারি লুটপাট। দেশের মানুষ একদিকে না খেতে পেরে মরতো, অন্যদিকে বিশাল জৌলুশে শেখ মুজিবের ছেলেদের বিয়েশাদির প্রোগ্রাম হতো। এগুলো নিয়ে তৎকালীন সিভিল সোসাইটির মানুষের ভেতর ব্যাপক ক্ষোভ ছিলো। যারা তৎকালীন সরকারের তোষামোদির বয়ানের বাইরে গিয়ে নির্মোহ বিশ্লেষণের মাধ্যমে লেখালেখি করতেন, তাদের লেখা পড়লে এইচিত্রগুলো খুব সহজেই চোখের সামনে ফুটে ওঠে।

এজন্যই ওই দুর্ভিক্ষের কথাবার্তা আমাদের সবাইকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। তা না হলে মানুষ তো সেই সময়ের অপশাসন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সদ্যস্বাধীন হওয়া একটা দেশের একদম প্রারম্ভিক যাত্রাটাই কীভাবে প্রশাসনিক আর দলীয় লুটপাটের মাধ্যমে বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়লো লাগলো, মানুষের স্পিরিটটাকে কীভাবে বিধ্বস্ত করে ফেলা হলো, এসবের জ্বলন্ত স্বাক্ষী হলো ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষ।

কবি রফিক আজাদের কবিতাটার কথা মনে আছে?

ওইযে৷ “ভাত দে হা রা ম জা দা, নইলে মানচিত্র খাবো”…

ওইটা কিন্তু ওই ১৯৭৪ সালে রচিত, দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে। এমনকি ওই কবিতাটা লেখার জন্য তৎকালীন লিগ সরকারের প্রশাসন ( স্পেসিফিক্যালি বললে পুলিশ) এর সামনে তাকে জবাবদিহি করতে হয়েছিলো। তাকে নানারকম বাধাবিপত্তি সহ্য করতে হয়েছিলো।

দেশের সিনিয়র সিটিজেন যারা আছেন, একদমই বয়স্ক না হলেও, ১৯৭৪ সালে যাদের বিচারবুদ্ধি করার মত বয়স হয়েছিলো, তাদের কাছে ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষের বর্ণনা শুনলে বোঝা যায়, কতোটা দুর্বিষহ ছিলো সেই ঘটনাক্রম।

আজকে যখন ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষের বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস কান্নায় ভেঙে পড়লেন, তখন তা বিশেষভাবে দাগ কেটে গেলো মনে। তৎকালীন লক্ষ লক্ষ হাড়জিরজিরে মানুষের কান্নার কষ্টগুলো যেন ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো ড. ইউনূসের কণ্ঠে।

তার সামনে বসে আছে দেশ বিদেশের বড় বড় বিজনেস গ্রুপের প্রতিনিধিরা। তাদেরকে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়গুলোতে বাংলাদেশের যাত্রা সম্পর্কে ব্রিফ করতে গিয়ে ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষের কথা টেনে আমাদের গতিপথ সম্পর্কে ধারণা দিলেন। সেই দুর্বিষহ সময় থেকে কীভাবে একটু একটু করে এগিয়ে আজকের এই বাংলাদেশ সেটা বুঝিয়ে বলে তারপর এখানে ইনভেস্ট করার আহ্বান জানালেন।

যাইহোক, ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষের ইতিহাস নিয়ে প্রত্যেকেরই জানাশোনার চেষ্টা করা উচিৎ। কীভাবে দেশের মানুষের সাথে জন্মলগ্নের পরবর্তী মুহূর্ত থেকেই প্রবঞ্চনা শুরু করেছিলো লিগের লোকজন, সেটার টেক্সটবুক এক্সামপল হলো ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষ। ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষ নিয়ে কথাবার্তা যতবেশি হতে থাকবে, লিগের অনেক চেতনার কলসি ফুটো হয়ে যেতে থাকবে। এজন্যই তারা ইতিহাসের ঘটনাকাল থেকে ১৯৭৪ কে সাইড করে রাখতে চেয়েছে চিরকাল। সেই গণ্ডিটা ভেঙে ফেলা উচিৎ সবার।