দ্য পলিটিশিয়ান রিপোর্ট :
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাস ছিল চরম উত্তেজনাপূর্ণ। ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের বর্ষপূর্তি ঘিরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপির মুখোমুখি অবস্থান ক্রমেই সংঘাতের দিকে গড়ায়। এই উত্তপ্ত সময়ে গুলশানের নিজ কার্যালয়ে কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। টানা সাত দিন পুলিশি পাহারায় সেখানে কাটান তিনি।
এই সময়ের ঘটনাবলি শুধু বিএনপির জন্য নয়, দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। কীভাবে শুরু হয়েছিল এই অবরুদ্ধ হওয়ার ঘটনা? কীভাবে কেটেছে সেই সাতটি দিন? ফিরে দেখা যাক সেই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ।
অবরুদ্ধ হওয়ার শুরু
২০১৫ সালের ৩ জানুয়ারি রাত। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুলশানের ৮৬ নম্বর সড়কের ৬ নম্বর বাড়িতে অবস্থিত তাঁর রাজনৈতিক কার্যালয়ে প্রবেশ করেন। এর কিছুক্ষণ পরই বাড়িটির চারপাশে অবস্থান নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে পুলিশি উপস্থিতি।
রাত ৯টার দিকে পুরো কার্যালয় ঘিরে ফেলে পুলিশ এবং একপর্যায়ে প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেয়। একই সঙ্গে কার্যালয়ের সামনের রাস্তা ইট, বালু ও মাটি ভর্তি ১১টি ট্রাক দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সরকারি সূত্রগুলো জানায়, বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে পারে—এমন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে বিএনপি নেতাদের দাবি, খালেদা জিয়া সেদিন নয়াপল্টনে অসুস্থ রুহুল কবির রিজভীকে দেখতে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পুলিশ তাঁর পথ আটকে দেয়।
প্রতিবন্ধকতা ও সংঘাতময় পরিস্থিতি
৪ জানুয়ারি বিএনপি ঘোষণা দেয়, সরকার অনুমতি না দিলেও ৫ জানুয়ারি তারা রাজধানীতে সমাবেশ করবে। পাল্টা অবস্থানে যায় আওয়ামী লীগও।
৫ জানুয়ারি দুপুরে খালেদা জিয়া কার্যালয় থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলে তাঁকে বাধা দেয় পুলিশ। বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেন, পুলিশ খালেদা জিয়াকে লক্ষ্য করে পেপার স্প্রে ছোড়ে, এতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয় বলে জানায় বিএনপি। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এটিকে “অসুস্থতার ভান” বলে দাবি করেন।
অবরুদ্ধ অবস্থায় জীবনযাপন
এই সাত দিন খালেদা জিয়ার সঙ্গে প্রায় ৫০ জন নেতাকর্মী কার্যালয়ের ভেতরে ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরীন সুলতানা, দলের উপদেষ্টা আবদুল কাইয়ুমসহ অনেকে।
খালেদা জিয়ার জন্য প্রথম দিন গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেল থেকে খাবার আনা হলেও পরে তারেক রহমানের স্ত্রীর বড় বোন শাহীনা খান তাঁর জন্য প্রতিদিন খাবার পাঠাতে থাকেন। অন্য নেতাদের খাবারের ব্যবস্থাও দলীয়ভাবে করা হয়।
ঘুমের জন্য প্রথম দিন তাঁর বাসা থেকে একটি খাট ও ম্যাট্রেস আনা হয়। কার্যালয়ে শীতবস্ত্র হিসেবে বিতরণের জন্য রাখা কম্বল বিছিয়ে অন্যান্যরা রাত কাটান।
তালা খোলা, আবার বন্ধ—অনিশ্চয়তার ঘূর্ণাবর্ত
৮ জানুয়ারি সকালে পুলিশের পক্ষ থেকে কার্যালয়ের প্রধান ফটকের তালা খুলে দেওয়া হয়। এতে মনে করা হচ্ছিল, খালেদা জিয়ার অবরুদ্ধ থাকার অবসান হতে যাচ্ছে। কিন্তু সন্ধ্যার পর আবারও ফটকে তালা দেওয়া হয়, নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয়।
৯ জানুয়ারি পর্যন্ত পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। কার্যালয়ের চারপাশে তখনও শতাধিক পুলিশ অবস্থান করছিল। জলকামান ও প্রিজন ভ্যান তখনও কার্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল।
সরকারের অবস্থান ও বিশ্লেষকদের মতামত
সরকারের পক্ষ থেকে শুরু থেকেই বলা হচ্ছিল, খালেদা জিয়া অবরুদ্ধ নন, চাইলে তিনি বাসায় ফিরতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪ জানুয়ারি বলেছিলেন, “উনি তো বন্দী নন। ইচ্ছা করলে উনি উনার বাসায় এখনই যেতে পারেন।”
তবে বিশ্লেষকদের অনেকেই সরকারের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত হননি। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেছিলেন, “কোনো রাজনৈতিক নেতার ওপর এ ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা যুক্তিসংগত নয়।”
অন্যদিকে, বিএনপি এটিকে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন বলে আখ্যা দেয়। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছিলেন, “তিনবারের প্রধানমন্ত্রীকে এভাবে অবরুদ্ধ করে রাখা সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক ও অমানবিক।”
এক নজরে সাত দিনের ঘটনাপ্রবাহ
তারিখ | ঘটনা |
---|---|
৩ জানুয়ারি | গুলশান কার্যালয়ে প্রবেশ করেন খালেদা জিয়া, পুলিশ ঘিরে ফেলে |
৪ জানুয়ারি | বিএনপির সমাবেশের ঘোষণা, উত্তেজনা বৃদ্ধি |
৫ জানুয়ারি | পেপার স্প্রে ছোড়া হয়, খালেদা জিয়া অসুস্থ |
৬ জানুয়ারি | আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা বিএনপির |
৭ জানুয়ারি | খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ বলে দাবি বিএনপির |
৮ জানুয়ারি | সকালে তালা খুলে সন্ধ্যায় আবার বন্ধ করে দেওয়া হয় |
৯ জানুয়ারি | পুলিশি পাহারা অব্যাহত থাকে |
গুলশান কার্যালয়ে খালেদা জিয়ার আটকে পড়ার ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে। এটি শুধু বিএনপি বা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশলের অংশ ছিল না, বরং দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দিক থেকেও এক নজিরবিহীন ঘটনা ছিল।
কারও কাছে এটি ছিল রাজনৈতিক প্রতিহিংসার প্রকাশ, কারও মতে, সরকার বিরোধী দলের আন্দোলন প্রতিহত করতে একটি কৌশলী পদক্ষেপ নিয়েছিল। তবে একথা নিশ্চিত, এই সাত দিন দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আলোচিত অধ্যায় হয়ে থাকবে, যা ভবিষ্যৎ রাজনীতির পথচলায়ও প্রভাব ফেলবে।