১৯৫৭ সালের ৭-৮ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারীতে অনুষ্ঠিত হয় এক ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সম্মেলন, যা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর আহ্বানে আয়োজিত এই সম্মেলনে তিনি স্পষ্টতই পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র অবস্থান নেন এবং ভবিষ্যতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার ইঙ্গিত দেন।
সম্মেলনের পটভূমি
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বৈষম্যের শিকার হতে থাকে। ভাষা আন্দোলন (১৯৫২) এবং যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের (১৯৫৪) পরও কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব বাংলার জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়।
১৯৫৬ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন এবং কেন্দ্রের সঙ্গে আপসের নীতি গ্রহণ করেন, যা মওলানা ভাসানী মেনে নিতে পারেননি। ফলে আওয়ামী লীগের ভেতরে ভাসানী ও শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন অংশের মধ্যে মতপার্থক্য বাড়তে থাকে। এই পরিস্থিতিতে ভাসানী কাগমারী সম্মেলনের ডাক দেন, যেখানে তিনি ভবিষ্যতের রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা দেন।
সম্মেলনের আয়োজন ও বিশাল জনসমাগম
সম্মেলনটি টাঙ্গাইল জেলার কাগমারীতে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে হাজার হাজার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-যুবক এবং রাজনৈতিক নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই অংশ নেননি, তবে সাধারণ জনগণের বিপুল সমর্থন ছিল মওলানা ভাসানীর পক্ষে।
সম্মেলনে প্রধান বক্তা ছিলেন মওলানা ভাসানী। এছাড়া, কয়েকজন প্রগতিশীল নেতা ও বুদ্ধিজীবীও বক্তব্য রাখেন।
ভাসানীর ঐতিহাসিক বক্তব্য
সম্মেলনে মওলানা ভাসানী তার বক্তব্যে সরাসরি পশ্চিম পাকিস্তানের দমননীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং বলেন—
“আমি পশ্চিম পাকিস্তানের দাসত্ব চাই না।”
তিনি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে কঠোর ভাষায় হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, পূর্ব বাংলার জনগণের ন্যায্য অধিকার যদি নিশ্চিত না করা হয়, তবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথই হবে একমাত্র সমাধান।
ভাসানী বলেন,
“পূর্ব বাংলার কৃষক-শ্রমিকরা শোষণের শিকার হচ্ছে, অথচ শাসকেরা আমাদের সম্পদ লুট করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা এ অন্যায় মেনে নেব না।”
তার ভাষণে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসে—
• পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি
• পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
• জনগণের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার আহ্বান
• আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিবর্তনের ইঙ্গিত
এই বক্তব্যের ফলে আওয়ামী লীগের মূলধারার সঙ্গে তার মতপার্থক্য আরও গভীর হয় এবং তিনি দল থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও পরিণাম
আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের অবস্থান
সম্মেলনের পর আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শেখ মুজিবসহ দলের অন্য নেতারা ভাসানীর চরমপন্থী অবস্থানকে স্বাগত জানাননি এবং কেন্দ্রের সঙ্গে আপসের নীতিই অনুসরণ করতে থাকেন।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন
এই সম্মেলনের কয়েক মাস পর মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ছেড়ে দেন এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন, যা পরবর্তীতে বামপন্থী ও প্রগতিশীল রাজনীতির অন্যতম শক্তি হয়ে ওঠে।
স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ রোপিত হয়
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, কাগমারী সম্মেলনই ছিল সেই প্রথম বড় রাজনৈতিক মঞ্চ, যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা দাবি এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তা বাস্তবে পরিণত হয়।
কাগমারী সম্মেলন শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক অনুষ্ঠান ছিল না, এটি ছিল পূর্ব বাংলার বঞ্চিত মানুষের সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। মওলানা ভাসানীর ঐতিহাসিক ঘোষণা ভবিষ্যতের মুক্তিযুদ্ধের পথকে সুগম করেছিল।
আজকের বাংলাদেশে যখন শোষণ ও বৈষম্যের প্রশ্ন আসে, তখন কাগমারীর চেতনা আবারও নতুন করে অনুপ্রেরণা যোগায়। এই সম্মেলন প্রমাণ করেছিল, বাংলার মানুষ কখনো শোষণের শৃঙ্খল মেনে নেয় না।