যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্কের ইতিহাস

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৫ ০৯:৩০ অপরাহ্ণ
প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৫ ০৯:৩০ অপরাহ্ণ


ইরান ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। সেই বিপ্লবে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনির নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত মোহাম্মদ রেজা পাহলভিকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।

এই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা একাধিক ইস্যুতে দীর্ঘদিন ধরেই বিদ্যমান – যেমন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি, মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বিস্তার এবং মার্কিন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ।

২০২৫ সালের সাম্প্রতিক উত্তেজনা:
সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রোববার একাধিক সরাসরি হামলার নির্দেশ দেন, যার লক্ষ্য ছিল ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলো। তিনি দাবি করেন, এই হামলা “ধ্বংস করে দিয়েছে” এসব সাইটকে। এর আগে ইসরায়েল ইরানের উপর নজিরবিহীন হামলা চালায়, তাদের অভিযোগ ছিল ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে। যদিও এই দাবির পক্ষে নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি, তবুও ট্রাম্প ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি যুদ্ধে জড়ান।

ওয়াশিংটন জানায়, ১২৫টিরও বেশি মার্কিন বিমান এবং ৭৫টি নির্ভুল বোমা ব্যবহার করে এই হামলা চালানো হয়। ইরান হুঁশিয়ারি দিয়েছে, তারা এর প্রতিশোধ নেবে।


টাইমলাইন: ১৯৫৩ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্ক

(১৯৫৩) যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত অভ্যুত্থান:
ইরানের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক ব্রিটিশ-নিয়ন্ত্রিত অ্যাংলো-ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি (বর্তমানে BP) জাতীয়করণের চেষ্টা করেন। যুক্তরাজ্য এবং সিআইএ মিলে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং পূর্বে নির্বাসিত পাহলভিকে পুনরায় রাজতন্ত্রে বসায়।

(১৯৫৭) পারমাণবিক সহযোগিতা (“Atoms for Peace”)
তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের “Atoms for Peace” কর্মসূচির অধীনে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান পারমাণবিক প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে এক চুক্তি করে। এই সহযোগিতা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ভিত্তি তৈরি করে।

(১৯৭৯) ইসলামি বিপ্লব:
শাহের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জনরোষ এবং পশ্চিমা হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ফলে বিপ্লব সংঘটিত হয়। আয়াতুল্লাহ খোমেইনি নির্বাসন থেকে ফিরে এসে ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।

(১৯৮০) কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন:
যুক্তরাষ্ট্র শাহকে ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য দেশে আশ্রয় দিলে, তেহরানে মার্কিন দূতাবাস দখল করে ৫২ জন আমেরিকানকে জিম্মি করে রাখা হয় ৪৪৪ দিন। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

(১৯৮০-৮৮) ইরান-ইরাক যুদ্ধ:
ইরাকের সাদ্দাম হোসেন ইরান আক্রমণ করলে যুক্তরাষ্ট্র ইরাককে সমর্থন করে। যুদ্ধ চলে ৮ বছর। ইরান লক্ষাধিক প্রাণ হারায়। ইরাক ইরানের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে।

(১৯৮৪) সন্ত্রাসে সহায়তা রাষ্ট্রের তকমা:
যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে “সন্ত্রাসে সহায়তাকারী রাষ্ট্র” ঘোষণা করে। লেবাননে হেজবুল্লাহ-সংশ্লিষ্ট হামলায় ২৪১ মার্কিন সেনা নিহত হয়। পরবর্তীতে ইরান-কনট্রা কেলেঙ্কারির মাধ্যমে দেখা যায়, প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান গোপনে ইরানের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন।

(১৯৮৮) ইরান এয়ার ফ্লাইট-৬৫৫ ধ্বংস:
যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর এক জাহাজ ভুলবশত একটি যাত্রীবাহী বিমান গুলি করে ধ্বংস করে, যাতে ২৯০ জন নিহত হয়। যুক্তরাষ্ট্র ভুল স্বীকার করলেও আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখপ্রকাশ করেনি।

(১৯৯৫) কঠোর নিষেধাজ্ঞা:
প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন, মার্কিন কোম্পানিগুলোর লেনদেন নিষিদ্ধ হয়।

(২০০২) ৯/১১ পরবর্তী অবস্থা ও “Axis of Evil”:
প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ইরানকে “Axis of Evil”-এর অন্তর্ভুক্ত ঘোষণা করেন। যদিও ইরান তখন আফগানিস্তানে তালেবান ও আল-কায়েদার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে সাহায্য করছিল।

(২০১৩-১৫) পরমাণু চুক্তি (JCPOA):
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উদ্যোগে ইরান পরমাণু কর্মসূচি সীমিত করতে সম্মত হয়, যার বিনিময়ে নিষেধাজ্ঞা শিথিল হয়।

(২০১৮) ট্রাম্প চুক্তি বাতিল করেন:
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প JCPOA থেকে একতরফাভাবে সরে আসেন এবং নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।

(২০২০) সোলেইমানি হত্যাকাণ্ড:
যুক্তরাষ্ট্র ইরানের কুদস ফোর্সের প্রধান জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে ড্রোন হামলায় হত্যা করে। ইরান পাল্টা হামলা চালায়।

(২০২৫) ট্রাম্পের চিঠি ও অস্থায়ী আলোচনা:
মার্চে ট্রাম্প ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনিকে এক চিঠি দিয়ে নতুন আলোচনা প্রস্তাব দেন, কিন্তু খামেনি প্রত্যাখ্যান করেন। ওমান ও ইতালিতে অপ্রাতিষ্ঠানিক আলোচনা হয়। ষষ্ঠ রাউন্ডের আগেই ইসরায়েল ইরান হামলা চালায়।

(২০২৫) যুক্তরাষ্ট্রের হামলা:
রবিবার, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়, যার ব্যাখ্যায় যুক্তরাষ্ট্র বলে এটি “ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও নিজেদের রক্ষায়” করা হয়েছে।