কবে দেশে ফিরছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান? দেশে ফিরলে তিনি কোন বাড়িতে উঠবেন? গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রাজনীতির মাঠে এই দুটি প্রশ্ন ঘিরেই চলছে তীব্র আলোচনা ও কৌতূহল।
তবে বিএনপির দায়িত্বশীল কোনো নেতাই এখনো পর্যন্ত তার দেশে ফেরার দিন-ক্ষণ বা নির্দিষ্ট আবাসস্থলের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। যদিও যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত ঘনিষ্ঠ নেতারা জানিয়েছেন, দেশে ফেরার বিষয়ে তারেক রহমান অত্যন্ত আগ্রহী।
যুক্তরাজ্য বিএনপির বক্তব্য
যুক্তরাজ্য বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব পারভেজ মল্লিক ডয়চে ভেলেকে বলেন,
“আমরা উনার সঙ্গে একাধিকবার এ বিষয়ে কথা বলেছি। উনি দেশে ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছেন। সর্বশেষ আমরা যেটা বুঝেছি, উনি জুলাই-আগস্টের মধ্যেই দেশে ফিরতে চান। নতুন করে কোনো সংকট তৈরি না হলে আগামী দুই মাসের মধ্যে উনি দেশে থাকবেন।”
তিনি আরও বলেন,
“গুলশান এভিনিউয়ের যে বাড়িটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সেখানে তিনি উঠবেন কি না, সেটাও এখনো নিশ্চিত নয়। উনি বলেছেন, যে বাড়িতে উঠবেন, সেখানে যেন মা ও ভাইয়ের স্ত্রীসহ পরিবারের সবাইকে নিয়ে থাকতে পারেন। ফলে ওই বাড়িটি উপযুক্ত কি না, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। গুলশানে তার জন্য অন্য বাড়িও খোঁজা হচ্ছে। পছন্দসই একটি বাড়ি পেলে ভাড়া বাড়িতেও তিনি উঠতে পারেন। ফলে কোনো কিছুই এখনও নিশ্চিত নয়। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সব নিশ্চিত হওয়া যাবে।”
ফখরুলের ইঙ্গিত ও সরকারের অবস্থান
১০ জুন গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন,
“তারেক রহমান অবশ্যই দেশে ফিরবেন। তিনি খুব শিগগিরই ফিরছেন।”
তবে তিনিও ফেরার সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখ উল্লেখ করেননি।
এরপর ১২ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন,
“তারেক রহমানের ফিরে আসার ক্ষেত্রে কোনো সরকারি বাধা নেই।”
ফলে দীর্ঘ ১৭ বছর পর তারেক রহমানের দেশে ফেরার পথে আর প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতা নেই বলেই মনে করা হচ্ছে।
গুলশানের বাড়ি: প্রস্তুতি ও জল্পনা
খালেদা জিয়ার বর্তমান আবাস ‘ফিরোজা’র পাশেই গুলশান-২ নম্বর এভিনিউ রোডের ১৯৬ নম্বর দোতলা বাড়িটি নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর খালেদা জিয়াকে ৩২ কাঠা জমির উপর নির্মিত এই বাড়িটি বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বর্তমানে বাড়িটি সম্পূর্ণরূপে সংস্কার ও সজ্জিত করা হয়েছে। বিদেশি একটি কোম্পানির কাছে এটি ভাড়া ছিল, যা ছয় মাস আগে খালি করা হয়।
নতুন করে বাড়ির বাইরের অংশে সাদা রঙ করা হয়েছে। ভিতরের অংশও সজ্জিত করা হয়েছে। নিরাপত্তা জোরদার করতে সীমানা দেয়ালে লোহার গ্রিল লাগানো হয়েছে।
আধুনিক এই ডুপ্লেক্স বাড়িটিতে রয়েছে:
- তিনটি শোবার ঘর
- প্রশস্ত ড্রয়িং ও লিভিং রুম
- একটি সুইমিং পুল
- দুটি পৃথক প্রবেশদ্বার
বাড়িটিতে বর্তমানে পুলিশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। তবে গুলশান থানার অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) মোখলেসুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন,
“তারেক রহমান সাহেব যে এই বাড়িতেই উঠবেন, এমন কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। বেগম খালেদা জিয়ার বাড়ি হিসেবে সেটাতে নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে। বিএনপির পক্ষ থেকে আমাদের কাছে নতুন করে কোনো বার্তা আসেনি যে, তারেক রহমান এই বাড়িতেই উঠবেন।”
জায়গাটি ঘুরে দেখেছেন ডা. জোবাইদা রহমান
সম্প্রতি দেশে ফিরে তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান ওই বাড়িটি পরিদর্শন করেছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে বাড়িটির নথিপত্র হস্তান্তর করেছেন।
দলীয়ভাবে নিশ্চিত কিছু নেই
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য সচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি ডয়চে ভেলেকে বলেন,
“আমাদের কাছে এখনও নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই যে, তারেক রহমান কবে দেশে ফিরছেন। আমাদের আভাস দেওয়া হয়েছে, উনি দ্রুতই দেশে ফিরছেন। আর গুলশানের বাড়িতে উঠার ব্যাপারেও আমাদের নিশ্চিত করে কিছু বলা হয়নি।”
ফেরার উপায়: পাসপোর্ট না ট্র্যাভেল পাশ?
২০০৮ সাল থেকে লন্ডনে অবস্থান করছেন তারেক রহমান। ওয়ান-ইলেভেনের সময় ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তিনি গ্রেপ্তার হন। ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে জামিন পান এবং ১১ সেপ্টেম্বর চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে চলে যান। সেই থেকে আর ফেরেননি।
এই মুহূর্তে তারেক রহমানের কাছে কোনো বৈধ পাসপোর্ট নেই। তাহলে তিনি কীভাবে ফিরবেন?
সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন,
“এই ধরনের ঘটনায় দেশে ফেরার দুটি প্রক্রিয়া আছে। যেহেতু তারেক রহমানের পাসপোর্ট নেই, চাইলে লন্ডনের বাংলাদেশ দূতাবাস তার নামে ট্র্যাভেল পাশ ইস্যু করতে পারে। সেই পাশ নিয়েই তিনি দেশে ফিরতে পারেন। আবার চাইলে পাসপোর্টও দেওয়া যেতে পারে। তবে তারেক রহমানের বিষয়টি তো সাধারণ নয়। তিনি যেভাবে ফিরতে চাইবেন, সেভাবেই দূতাবাস বা সরকার ব্যবস্থা নেবে।”
তিনি আরও বলেন,
“পাসপোর্ট করতে কিছু নিয়ম-কানুন মানতে হয়, তাতে ১০-১৫ দিন সময় লাগে। এখন দূতাবাসেই পাসপোর্ট ছাপা হয়, বাংলাদেশে পাঠানো লাগে না। তবে আমার মতে, তারেক রহমান ট্র্যাভেল পাশ নিয়ে দেশে ফিরে এখান থেকে পাসপোর্ট করলেই ভালো হবে।”
ফিরলেও আইনি ঝুঁকি কি রয়ে যাবে?
তারেক রহমানের দেশে ফেরার ক্ষেত্রে আরেকটি বড় প্রশ্ন উঠে এসেছে—আবার যদি মামলার শুনানি হয়, তাহলে পূর্বে বেকসুর খালাস পাওয়া রায়গুলোও বদলে যেতে পারে কি না? এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
তবে অনেকের মতে, সম্প্রতি লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের যেসব বৈঠক হয়েছে, সেগুলোতে এসব বিষয় আলোচনায় এসেছে। ফলে তিনি কিছুটা আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছেন বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
তারেক রহমানের দেশে ফেরা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। যদিও দিনক্ষণ এখনও নির্দিষ্ট নয়, তবুও প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে। রাজনৈতিক অঙ্গনে তার প্রত্যাবর্তন নতুন মাত্রা যোগ করবে বলেই বিশ্লেষকদের মত। তবে তিনি কোথায় থাকবেন, কীভাবে ফিরবেন এবং ফিরে কী ধরনের আইনি পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন—এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সময়ই দেবে।