লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে শুক্রবার সকালে অনুষ্ঠিত হলো বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক। বৈঠকে অংশ নেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। স্থানীয় সময় সকাল ৯টায় শুরু হয়ে দেড় ঘণ্টা ধরে চলে এই আলোচনা, যা শেষ হয় সকাল সাড়ে ১০টায়। বৈঠক শেষে হোটেলেই আয়োজন করা হয় এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনের।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে অধ্যাপক ইউনূসের দফতরের প্রেস সচিব শফিকুল আলম একটি যৌথ বিবৃতি পড়ে শোনান। এতে বলা হয়, বৈঠকটি অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। তারেক রহমান বৈঠকে প্রস্তাব করেন, আগামী বছরের রমজানের আগেই যেন নির্বাচন আয়োজন করা হয়। এ বিষয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ারও একই মত রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস জানান, তিনি নিজেও এপ্রিলের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। তবে তিনি এটাও স্পষ্ট করেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন করতে হলে সংস্কার ও বিচার বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি থাকতে হবে। এমনকি তিনি বলেন, যদি সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়, তাহলে ২০২৬ সালের রমজান শুরুর আগের সপ্তাহেও নির্বাচন সম্ভব। তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার এ অবস্থানকে স্বাগত জানান এবং ধন্যবাদ জানান ফলপ্রসূ আলোচনার জন্য। ইউনূসও তারেক রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
বৈঠক-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। জুলাই সনদ নিয়ে এক প্রশ্নে আমীর খসরু বলেন, এই বিষয়ে দেশে আলোচনা চলছে এবং এর ভিত্তিতে একটি ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। ঐকমত্যের ভিত্তিতেই জুলাই সনদ চূড়ান্ত হবে। সংস্কার প্রসঙ্গেও তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে ও পরে—উভয় সময়েই সংস্কার চলবে, এবং সেখানে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য থাকবে, সেগুলোই প্রাধান্য পাবে।
নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ নিয়ে কোনো জটিলতা আছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে খলিলুর রহমান বলেন, তাদের দৃষ্টিতে এ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। বরং নির্বাচন কমিশন শিগগিরই তারিখ ঘোষণা করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
আলোচনায় কি শুধু নির্বাচন, না কি দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রসঙ্গও এসেছে—এমন প্রশ্নে আমীর খসরু বলেন, তারা একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে এগোচ্ছেন, এবং এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে সব বিষয় নিয়েই আলোচনা হয়েছে। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, এই ঐকমত্য শুধু নির্বাচনের আগে নয়, নির্বাচনের পরও কার্যকর থাকবে।
সংস্কার নিয়ে সরকারের দেওয়া প্রস্তাবনা নিয়ে বিএনপির অবস্থান জানতে চাইলে আমীর খসরু বলেন, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সবাই একমত যে সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং তা সময় ও প্রেক্ষাপট অনুযায়ী বাস্তবায়িত হবে। নির্বাচনের আগে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য থাকবে, তা তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হবে এবং পরবর্তী সময়েও সংস্কার চলতে থাকবে।
তারেক রহমানের দেশে ফেরার প্রসঙ্গেও সাংবাদিকরা জানতে চান। এ বিষয়ে আমীর খসরু জানান, আলোচনা করার মতো তেমন কিছু নেই। তারেক রহমান নিজেই সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি কবে দেশে ফিরবেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্য উদ্ধৃত করে এক সাংবাদিক উল্লেখ করেন, তার দেশে ফিরতে কোনো বাধা নেই। খসরু বলেন, সিদ্ধান্ত তারেক রহমানের, এবং সময়মতো তিনি তা নেবেন।
আরও একটি প্রশ্ন ছিল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিচারপ্রক্রিয়া ও সেটির নির্বাচনী রূপরেখায় প্রভাব বিষয়ে। এ প্রশ্নের উত্তরে নিরাপত্তা উপদেষ্টা জানান, যৌথ বিবৃতিতেই বলা হয়েছে, সংস্কার এবং বিচার—এই দুটি বিষয়ে নির্বাচন পূর্ব সময়ে যথেষ্ট অগ্রগতি হবে। এর সঙ্গে আমীর খসরু যোগ করেন, ‘সম্পন্ন করা যাবে’।
নতুন দল এনসিপির নির্বাচন কমিশন সংস্কার ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা নিয়েও একটি প্রশ্ন ওঠে। এতে আমীর খসরু বলেন, এ বিষয়ে এখানে আলোচনার সুযোগ নেই। খলিলুর রহমান বলেন, প্রতিটি দলের নিজস্ব মতামত আছে এবং তা তারা নিজেরা ব্যাখ্যা করবে। তবে তিনি বলেন, সরকার চায়, সবাইকে নিয়েই যেন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
সংবাদ সম্মেলনের শেষদিকে প্রশ্ন করা হয়, সরকার কি নির্বাচনের ঘোষিত রূপরেখা থেকে কিছুটা সরে আসতে যাচ্ছে? উত্তরে খলিলুর রহমান বলেন, যৌথ ঘোষণায় এ বিষয়ে সবকিছু স্পষ্ট করা আছে। কাজগুলো সময়মতো হলে এবং বিচার ও সংস্কার যথাযথভাবে সম্পন্ন হলে, নির্বাচনের সময়েও তা বিবেচনায় নেওয়া যাবে।
সংবাদ সম্মেলনের শেষ প্রশ্ন ছিল: ‘‘আপনারা কি সন্তুষ্ট?’’—জবাবে খলিলুর রহমান ও আমীর খসরু একসঙ্গে বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট।’’
আমীর খসরু বলেন, তারা শুধু নির্বাচনের আগেই নয়, বরং নির্বাচন পরবর্তী বাংলাদেশ গঠনে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে চান। খলিলুর রহমানের শেষ বক্তব্য ছিল সংক্ষিপ্ত, তবে তাৎপর্যপূর্ণ—‘‘সন্তুষ্ট না হলে তো যৌথ ঘোষণা আসত না।’’