বিবাদে জাড়ালো জামায়াত ও এনসিপি

প্রকাশ: ১৫ মে ২০২৫ ০৯:৩০ অপরাহ্ণ
প্রকাশ: ১৫ মে ২০২৫ ০৯:৩০ অপরাহ্ণ

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির। এরপর ৯ মাসে বিভিন্ন বিষয়ে নানা কর্মসূচি পালনেও তাদের বন্ধন অটুট ছিল।সর্বশেষ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনেও তাদের এক কাতারে দেখা গেছে। কিন্তু সরকার ফ্যাসিস্ট দলটির বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত জানানোর পর থেকে পক্ষগুলোর মধ্যে বিভাজন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কথার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে ছাত্রদের নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি এবং জামায়াত।

দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা জানিয়েছে, এনসিপি এবং অন্তর্বর্তী সরকারে থাকা দলটির ঘনিষ্ঠ দায়িত্বশীলরা নানা বিদ্বেষমূলক কথা বলছে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরকে জড়িয়ে। তারাও জবাব দিচ্ছে নানাভাবে। এতেই এক রকম তর্কযুদ্ধ বেধে গেছে পক্ষ দুটির মধ্যে। এনসিপি বলছে, জামায়াতকে একাত্তর প্রশ্নে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। শাহবাগে ‘গোলাম আযমের বাংলায়, আওয়ামী লীগের ঠাঁই নাই’ স্লোগান এনসিপি দেয়নি। যারা এ স্লোগান দিয়েছে তাদেরই এর দায়িত্ব নিতে হবে।

অপরদিকে জামায়াতের পক্ষ থেকে এনসিপিকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়, নবগঠিত দলটির মাথামোটা কয়েক নেতা ব্যক্তিস্বার্থে নতুন বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে। যা জুলাই বিপ্লবের ঐক্যে ফাটলের পাশাপাশি নতুন করে ফ্যাসিবাদ তৈরি করতে পারে।সম্প্রতি আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে অধ্যাপক গোলাম আযমের নামে স্লোগান আর জাতীয় সংগীত পরিবেশনে বাধা সংক্রান্ত অন্তত দুটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হলে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে।

এতে আন্দোলনকারীদের বিজয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাস আর ফ্যাসিবাদের বিচার দাবি জোরদারের তৎপরতায় ছন্দপতন ঘটে। এক পর্যায়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়া শুরু হয়। গোলাম আযমের নামে স্লোগান এবং জাতীয় সংগীতে বাধা দেওয়ার বিষয়টিও আলোচনায় আসে। একই সঙ্গে নতুন করে বিতর্কে আসে একাত্তর প্রসঙ্গ।এনসিপি নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতির পাশাপাশি তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের স্ট্যাটাস নিয়েও বিতর্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক বিতর্ক চলছে।

এ বিষয়ে বেশ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন শিবির নেতারা। জামায়াতের নীতি-নির্ধারকরাও এ নিয়ে আলোচনা করেছেন, তবে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি দলটি। এসব বিষয়ে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে এনসিপি এবং তথ্য উপদেষ্টার প্রকাশ্য বিরোধ দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। এতে সংশ্লিষ্টদের মাঝে বেশ চাপা অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের এই সহযোদ্ধাদের মাঝে বিভেদ তৈরি করে কেউ বিশেষ ফায়দা লুটতে চায়।

এতে ইসলাম ও দেশবিরোধী একটি চক্র তথা ভারতীয় কোনো এজেন্টের ইন্ধন থাকতে পারে।শাহবাগের ছাত্র-জনতার অবস্থানের অন্তত দুটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। তার একটিতে দেখা যায়, এনসিপি নেতারা জাতীয় সংগীত গাইতে শুরু করলে কিছু লোক বলতে থাকেনÑ ‘জাতীয় সংগীত হবে না’। গান থামাতে ব্যর্থ হয়ে তাদের ‘ভুয়া’, ‘ভুয়া’ স্লোগান দিতেও দেখা যায়।অন্য ভিডিওতে দেখা যায়, শাহবাগের আন্দোলনের এক পাশে অবস্থান করা লোকজন ‘গোলাম আযমের বাংলায়, আওয়ামী লীগের ঠাঁই নাই’, ‘সাঈদীর বাংলায়, আওয়ামী লীগের ঠাঁই নাই’ স্লোগান দিচ্ছেন। এ নিয়ে আওয়ামী, বামসহ বিভিন্ন ঘরানার লোকজন সামাজিক মাধ্যমে বিতর্ক শুরু করেন।

পরদিন রোববার সন্ধ্যায় নিজের ভেরিফায়েড আইডিতে পোস্ট দেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, সেটি ৩ মিনিটের মাথায় আর পাওয়া যায়নি। তাতে বলা হয়েছিল, ‘আমাকে নিয়ে নোংরামি করতেসো, ঝামেলা নাই। ফ্যামিলি টাইনো না, যুদ্ধাপরাধের সহযোগী রাজাকারেরা। এটা লাস্ট ওয়ার্নিং। আর, যে চুপা শিবিররা এ সরকারে পদ বাগাইসো আর বিভিন্ন সুশীল ব্যানার খুলে পাকিস্তানপন্থা জারি রাখসো, তোমরা তোমাদের পূর্বপুরুষ রাজাকার আর দালালদের তুলনায় আরো অধিক ভুগবা।

যারা বিতর্কের এবং গালাগালির লিমিট জানে না, তাদের আমি সহনাগরিক মনে করি না। পাকিস্তানপন্থিরা যেখানেই থাকবে, সেখানেই আঘাত করা হবে। আমৃত্যু! ঢাবিতে এ রাজাকারদের আগে ঠেকানো হবে, যারা এদের স্পেস দিসে তাদের জন্য গত পঞ্চাশ বছরের তুলনায় অধিক জিল্লতি অপেক্ষা করসে!’এই পোস্টের পর জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের অনেক নেতাকে বিচ্ছিন্নভাবে মাহফুজ আলমের বক্তব্যের সমালোচনা করতে দেখা যায়। উপদেষ্টা পরিষদে থাকা অবস্থায় একটি দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন দাবি করে তার বিরুদ্ধে ‘শপথ ভঙ্গের’ অভিযোগও করতে দেখা গেছে। এমন প্রশ্ন তুলে শাহবাগ থানা জামায়াতের আমির শাহ মাহফুজুল হক টিভি অনুষ্ঠানে মাহফুজ আলমের ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর হয়ে কাজ করছেন কিনা– সেই প্রশ্নও তুলতে দেখা যায়।

পরে ‘দুটি কথা’ শিরোনামে মাহফুজ আলম আরেক ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘১. ৭১-এর প্রশ্ন মীমাংসা করতেই হবে। যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে। বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে পাকিস্তানপন্থা বাদ দিতে হবে। পাকিস্তান এদেশে গণহত্যা চলিয়েছে। (পাকিস্তান অফিসিয়ালি ক্ষমা চাইলেও, তদুপরি আবারো ক্ষমা চাইতে রাজি হলেও, যুদ্ধাপরাধের সহযোগীরা এখনো ক্ষমা চায়নি)। ইনিয়ে বিনিয়ে গণহত্যার পক্ষে বয়ান উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। জুলাইয়ের শক্তির মধ্যে ঢুকে স্যাবোটাজ করা বন্ধ করতে হবে। সাফ দিলে আসতে হবে। ২. মুজিববাদী বামদের ক্ষমা নাই। লীগের গুম-খুন আর শাপলায়, মোদীবিরোধী আন্দোলনে হত্যাযজ্ঞের মস্তিষ্ক এরা।

এরা থার্টি সিক্সথ ডিভিশন। জুলাইয়ের সময়ে এরা নিকৃষ্ট দালালি করেও এখন বহাল তবিয়তে আছে। আজ পর্যন্ত মুজিববাদী বামেরা কালচারালি ও ইন্টেলেকচুয়ালি জুলাইয়ের সঙ্গে গাদ্দারি করছে। দেশে বসে জুলাইয়ের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে এরা চক্রান্ত করেই যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের এসব বিটিমও শিগগিরই পরাজিত হবে। অন্য কারো কাঁধে ভর করে লাভ নেই।’সোমবার ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের আহবায়ক আবু বাকের মজুমদার বলেন, ‘তোরা যারা রাজাকার, সময় থাকতে বাংলা ছাড়!

লাখো শহীদের রক্তে কেনা, দেশটা কারও বাপের না! গোলাম আযম তুই রাজাকার, বাংলা কি তোর বাপ-দাদার?’এদিকে মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, দেশে জাতীয় সংগীতকে অবমাননা ও একাত্তরকে উপেক্ষাকারীদের রাজনীতি বুমেরাং হবে। এনসিপি এই দুই বিষয়ে কাউকে ছাড় দেবে না। তাই যারা এখনো নানাভাবে জাতীয় সংগীত ও মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করতে চান, এখনো সময় আছে সঠিক পথে ফিরে আসুন।

জানা গেছে, এনসিপি নেতাদের বক্তব্য ও উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের স্ট্যাটাস নিয়ে সোমবার জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে শীর্ষনেতাদের জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া মঙ্গলবার জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের বৈঠকেও এসব বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি দলটি।এ বিষয়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের প্রধান এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, এ বিষয়ে আমরা আরেকটু সময় নিয়ে কথা বলব।

তবে দলটির আরেক কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, যে স্বপ্ন নিয়ে ছাত্র-জনতা রক্ত ঝরিয়েছে, জীবন দিয়েছেÑ সে স্বপ্ন এখনো পূরণ হয়নি। যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। এ পর্যায়ে এ ধরনের পুরোনো কাসুন্দি বিভাজনমূলক কথা জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থি। এসব কথা দেশের মানুষ অনেক আগেই প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ফ্যাসিবাদ চিরতরে নির্মূল করতে হবে।এর আগে উপদেষ্টা মাহফুজের ওই বক্তব্যের পর নিজের ফেসবুক পেজে এক স্ট্যাটাসে কোনো উসকানি কিংবা অপ্রীতিকর ঘটনায় না জড়াতে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান।

সূত্র : আমার দেশ ।