বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, লেখক ও সমাজ সেবক আবুল কাসেম হায়দার তার লেখা বই ‘ বাংলাদেশের উন্নয়নের ইতিহাস’ নামক গ্রন্থে উঠে এসেছে, একবার খালেদা জিয়া তার বাসভবনে দেওয়াল টপকে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঐতিহাসিক ঘটনা।
সেই বই থেকে জানা যায়, ১৫ অক্টোবর ‘৮৬ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের নামে এক প্রহসন অনুষ্ঠিত হয়। তিন জোট এ নির্বাচন বর্জন করে এবং সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহ্বান করে। সারাদেশে সফল হরতাল পালিত হয়। জনগণ স্বতঃস্ফুর্তভাবে এ নির্বাচনে অংশ না নিলেও সরকারিভাবে ৬০% ভাগ ভোট পড়েছে এবং প্রদত্ত ভোটের ৮০% এরশাদ পেয়েছেন বলে ফলাও করে প্রচার করা হয়।
১৯৮৭ সালের শুরুতেই বেগম খালেদা জিয়া এরশাদের পদত্যাগের ‘এক দফা’র দাবীতে দলমত নির্বিশেষে দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। ২৯ মার্চ ৩১ জন বুদ্ধিজীবীর কণ্ঠে বেগম জিয়ার ভাষারই প্রতিফলন ঘটে।
তাঁরা দেশের সার্বিক অবস্থা ‘হতাশাব্যঞ্জক’ বলে বিবৃতি দিয়ে এ অবস্থা হতে মুক্তির উপায় হিসেবে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন দাবী করেন। ১২ জুলাই ‘৮৭ জাতীয় সংসদে জেলা পরিষদ বিল পাস হয়। এ বিলের প্রতিবাদে তিন জোট ও জামায়াতে ইসলামী ২২ জুলাই থেকে ৫৪ ঘণ্টার লাগাতার হরতাল ঘোষণা করে।
হরতাল চলাকালীন সময়ে ২২ জুলাই বেগম জিয়া গভীর রাতে বৃষ্টির মধ্যে তাঁর বাসার পাহারারত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে পেছনের দেয়াল টপকে বাসা থেকে বের হয়ে বনানীতে এক আত্মীয়ের বাসায় রাত্রিযাপন করে পরদিন সকালে বনানী থেকে মিছিল সহকারে দীর্ঘ ১২ মাইল পথ হেঁটে বিকেলে প্রেসক্লাবে আসেন। বেগম জিয়া রাস্তার হাজার হাজার লোকের মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ায় এবং সারাদিন রাজপথে থাকায় মূলত এদিন সমগ্র রাজধানী বিএনপি’র দখলে চলে যায়।
৫৪ ঘন্টা হরতাল চলাকালে ৭ ও ৮ দলীয় জোট আবার কাছাকাছি এসে পড়ে। দেশব্যাপী দাবী উঠতে থাকে দুই নেত্রীকে এক মঞ্চ থেকে আন্দোলন করার জন্য। ২৭ সেপ্টেম্বর তিন জোটের লিয়াজোঁ কমিটি ১০ নভেম্বর ঢাকা অবরোধ কর্মসূচী ঘোষণা করে। জনতার দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে ২৮ অক্টোবর দুই নেত্রী এক অন্তরঙ্গ বৈঠকে বসেন এবং একটি যুক্ত ঘোষণায় স্বাক্ষর করেন। বিবৃতিতে সকল ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে ১ ও ১০ নভেম্বর হরতালসহ সকল কর্মসূচী বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়।
ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করে। আন্দোলন আবার প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে। ফলে সরকার ১৪৪ ধারা জারী করে এবং সকল প্রকার সভা, সমাবেশ ও মিছিল সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ৯ নভেম্বর সারাদিনই ১৪৪ ধারা অমান্য করে নগরীর অলিতে গলিতে মিছিল-সমাবেশ হয়। এদিন বিকালে গুলিস্তান চত্ত্বরে বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন মিছিলে পুলিশ অতর্কিত হামলা চালার যাতে বেগম জিয়াসহ ১১ জন আহত হন।
১০ নভেম্বর ৮৭ সকাল ১১টার দিকে পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তিনি শাপলা চত্বরে উপস্থিত হয়ে জনতার উদ্দেশ্যে এক জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখেন । তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, “স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার জনতার আন্দোলনে ভীত হয়ে রাজপথ, রেলপথ, পানিপথ বন্ধ করে দিয়ে কার্যত ঢাকা মহানগরীকে একটি বন্দী শিবিরে পরিণত করেছে। ১৪৪ ধারা জারি করেছে। পাঁচজনের অধিক সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীকে পাইকারি হারে গ্রেফতার করেছে। শত নিপীড়ন ও অত্যাচারের পরও জেল, জুলুম, হুলিয়া এমন কি জীবনের মায়া ত্যাগ করেও শত বাধা- বিপত্তি অতিক্রম করে আজকের এ সমাবেশে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিই প্রমাণ করে যে, জনগণ আর এক মুহূর্তের জন্যও স্বৈরশাসক এরশাদকে চায় না। জনতার দাবীর প্রতি যদি সামান্যতম শ্রদ্ধা থাকে তবে তাকে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে।
অন্যথায় জনগণ টেনে-হেঁচড়ে তাকে ক্ষমতা থেকে নামাবে।” সমাবেশ শেষে অনুষ্ঠিত বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন মিছিলটি আল্লাহওয়ালা ভবনের সামনে আসলে উক্ত ভবন থেকে মিছিলে বোমা ও গুলিবর্ষণ করা হয়। মিছিলটি দৈনিক বাংলা অফিসের মোড়ে আসলে পুলিশ ও বিডিআর অতর্কিতে মিছিলের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে।
এতে ঘটনাস্থলেই ২জন নিহত ও ৫ জন আহত হয়। এদিনই বিডিআরের গুলিতে নিহত হয় নূর হোসেন নামের একটি ছেলে যার বুকে পিঠে লেখা ছিল “গণতন্ত্র মুক্তি পাক- স্বৈরাচার নিপাত যাক”। বেগম জিয়া পরদিন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার জন্য হোটেল পূর্বাণীতে অবস্থান করেন। ১১ নভেম্বর সকাল ১০টায় পুলিশ হোটেল পূর্বাণী থেকে তাকে গ্রেফতার করে জীপে তোলে। গ্রেফতারকালে বেগম জিয়া জীপের পা-দানীতে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের বলেন, স্বৈরাচারী এরশাদের পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে, সকল প্রকার কর্মসূচী অব্যাহত থাকবে। তিনি দেশে গণতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন অব্যাহত রাখার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।
সেদিন হোটেল পূর্বাণীতে বেগম খালেদা জিয়াকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। কিন্তু একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বেগম জিয়ার বিশ্বস্ত দু’জন সাংবাদিককে একথা জানালে তাদের দ্রুত পদক্ষেপে বেগম জিয়া নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। ইতোমধ্যে সরকার জাতীয় সংসদ বাতিল করে ২৮ ফেব্রুয়ারী ৮৮ নতুন নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করে।
১৯৮৭ সালের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রিত হয়েছে বেগম খালেদা জিয়াকে ঘিরেই। নিজের জীবনকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে আপোসহীন ভূমিকা রেখে তিনি আন্তর্জাতিক বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন । বিশ্বের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর আপোসহীন ভূমিকার অকুণ্ঠ প্রশংসা করা হয়। এসময় তিনি সমগ্র বিশ্বে একজন অনমনীয় ও একজন দৃঢ়চেতা রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। আন্দোলনকারীরা তাঁকে ‘দেশনেত্রী’ খেতাবে ভূষিত করে।
১২ জানুয়ারী ৮৮ বেগম খালেদা জিয়া দেশব্যাপী গণসংযোগ সফর শুরু করেন। গণসংযোগ কর্মসূচীর প্রথম দিনে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাবার পথে কমলাপুর রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন পথসভায় সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণদানকালে তিনি বলেন, ‘২৮ ফেব্রুয়ারির প্রহসনের নির্বাচন জনগণ মানবে না। এ সরকারের অধীনে কোন নির্বাচনী বিধিও নিরপেক্ষ হতে পারে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা নির্বাচন চাই, তবে জেনারেল এরশাদের অধীনে কোন নির্বাচন দেশের জনগণ মেনে নেবে না ।
‘ তিনি সরকারকে চ্যালেঞ্জ নিয়ে বলেন, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বিএনপি ৩০০ আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে এবং আগের মত জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসবে। ৫ জুন ‘৮৮ ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে বিএনপির বর্ধিত সভায় উদ্বোধনী বক্তৃতায় বেগম জিয়া বলেন, ‘এদেশটা এদেশের ১০ কোটি মানুষের। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া কোন ভাগ-বাটোয়ারার কোন ফসল নয়। অজস্র মা-বোনের বেদনা আর স্বজন হারানোর অশ্রুতে ভিজে আছে এদেশের মাটি।