বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হলো। গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা এবং নতুন সংবিধান প্রণয়ন—এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করেছে। তরুণদের নেতৃত্বে গঠিত এই দলটি পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভেঙে নতুন এক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের ঘোষণা দিয়েছে।
নতুন পথের সন্ধানে তরুণ নেতৃত্ব
শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে এক বিশাল সমাবেশে দলটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। সমাবেশে বিপুলসংখ্যক তরুণ, ছাত্র-জনতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। নাহিদ ইসলাম দলের আহ্বায়ক এবং আখতার হোসেন সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন।
নাহিদ ইসলাম বলেন, “বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা আশাবাদী। আমরা শুধু অতীতের ভুল চর্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চাই না, আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই। আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাই, যেখানে দেশ পরিচালনার মূল ভিত্তি হবে জনগণের স্বার্থ, কোনো বিদেশি শক্তির ইশারা নয়।”
সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, “নতুন সংবিধানই হবে রাষ্ট্রের ভিত্তি। তরুণরা নেতৃত্ব দেবে, দুর্নীতি-চাঁদাবাজির রাজনীতি শেষ হবে। এখানে দিনের ভোট রাতে হবে না।”
গণপরিষদ নির্বাচন: নতুন রাজনীতির ভিত্তি
জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা জানিয়েছেন, তাঁদের মূল লক্ষ্য গণপরিষদ নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা। দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, নতুন সংবিধান প্রণয়ন শেষ না হওয়া পর্যন্ত জাতীয় পরিষদ দায়িত্ব পালন করবে। এরপর সংসদীয় কাঠামোতে যাত্রা শুরু করবে নতুন বাংলাদেশ।
এই দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, “আমাদের লক্ষ্য দলনির্ভর নয়, নীতিনির্ভর বাংলাদেশ গঠন করা। ক্ষমতা কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের হাতে কুক্ষিগত থাকবে না। বাংলাদেশে আর বাইনারি রাজনীতির জায়গা থাকবে না।”
নতুন রাজনৈতিক কাঠামো: পরিবারের রাজনীতির অবসান
জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাঁদের দলে পরিবারতন্ত্র থাকবে না। ব্যক্তি বা পরিবারের পরিচয়ের চেয়ে নেতৃত্ব নির্বাচনে যোগ্যতা ও আদর্শ হবে মুখ্য।
দলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, “এতদিন আমাদের সামনে মাত্র দুটি পথ খোলা ছিল—একটি দল না হলে আরেকটি দল। জনগণের সামনে কোনো নতুন রাজনৈতিক বিকল্প ছিল না। আমরা সেই বিকল্প তৈরি করতে চাই, যেখানে নীতিই হবে একমাত্র পথনির্দেশক।”
আত্মপ্রকাশের মুহূর্ত: ইতিহাসের অংশ হওয়ার প্রত্যয়
সমাবেশ শুরু হয় বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে পবিত্র কুরআন, গীতা, বাইবেল ও ত্রিপিটক পাঠের মাধ্যমে। এরপর জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হয় এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের স্মরণে ১ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
শহীদ ইসমাঈল হোসেন রাব্বির বোন মীম আক্তার, যিনি আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে দলের নাম ঘোষণা করেন, বলেন, “৫ আগস্ট আমার ভাইয়ের লাশ আমি কাঁধে বহন করেছি। ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল। সেই আত্মত্যাগের পর আজকের এই মুহূর্ত ইতিহাসের অংশ হতে চলেছে।”
এরপর মঞ্চে ডাকা হয় জুলাই অভ্যুত্থানের নায়কদের। দেখানো হয় জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে নির্মিত একটি ডকুমেন্টারি। সমাবেশস্থলে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা হাজারো ছাত্র-জনতা উপস্থিত ছিলেন, যাঁরা পতাকা হাতে নিয়ে মিছিল করছিলেন।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ: তরুণদের হাতে নেতৃত্ব
জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে তরুণদের বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা লক্ষ করা গেছে। এই রাজনৈতিক দলটি একটি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যেখানে জনগণের মতামতই হবে প্রধান সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভিত্তি।
নতুন দল সম্পর্কে বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একটি নতুন ধারার সূচনা করতে পারে, যেখানে পুরোনো দলীয় রাজনীতির বাইরে গিয়ে নীতিনির্ভর নেতৃত্ব গড়ে উঠবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ শুধু একটি নতুন রাজনৈতিক দলের উত্থান নয়, বরং এটি একটি নতুন রাজনৈতিক আদর্শের জন্ম। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই নতুন শক্তি কী পরিবর্তন আনতে পারে, তা সময়ই বলে দেবে।