ইতিহাস ডে ।।
সাদেক হোসেন খোকা বামপন্থী রাজনীতি থেকে এসেছিলেন জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে। ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মা’কে এমনকি পরিবারের অন্য কাউকে কিছু না জানিয়েই যুদ্ধে গিয়েছিলেন। ভয়ংকর গেরিলা যোদ্ধা হিসাবে পরিস্থিতি তার। সাদিক হোসেন খোকা তার একটি লেখায় তুলে ধরেছেন সেসব গেরিলা হামলার রোমাঞ্চকর ইতিহাস।
সাদিক হোসেন খোকা লিখেন, মেলাঘরের ট্রেনিং ক্যাম্পে মাঝে-মধ্যেই মায়ের স্নেহাস্পর্শ পাওয়ার তৃষ্ণায় হৃদয়টা হাহাকার করে উঠতো। ট্রেনিং শেষে ঢাকায় অপারেশনের ফাঁকে গোপনে একবার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এলাম, অবশ্যই ঝুঁকি নিয়ে রাতের বেলায়। সকালে নিজ হাতে নাশতা বানিয়ে পাশে বসে খাওয়াতে খাওয়াতে মা বললেন, ‘আর যুদ্ধে যেতে পারবে না। কারণ তোমার হাতে কোনো মানুষ খুন হোক তা আমি চাই না।’ ভাবনায় পড়ে গেলাম, মাকে কী করে ম্যানেজ করি? আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, মা আমাকে যেতে হবে। আর আমরা তো যুদ্ধই করছি পাকিস্তানি দখলদারদের মেরে ভয় দেখিয়ে এদেশ থেকে বিতাড়িত করতে। তিনি যখন দেখলেন আমাকে ফেরানো যাবে না তখন বললেন, ‘আমাকে কথা দাও অন্যায়ভাবে ঠাণ্ডা মাথায় কাউকে হত্যা করতে পারবে না।’ মায়ের কথায় রাজি হয়ে আবার ফিরে যাই রণাঙ্গনে।
সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত যেসব স্লোগান জনপ্রিয় হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম একটি ছিল, ১৯৭১-এর এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন নেতা রুহুল আমীন এবং গোপীবাগের মাসুদসহ (বুড়া) বেশ কয়েকজন মিলে প্রথমে আমরা যাই নরসিংদীর শিবপুরে। ওখানে কয়েক দিন অবস্থানের পর যুদ্ধের ট্রেনিং নেয়ার জন্য আগরতলার উদ্দেশে রওনা দেই। আগরতলায় আমাদের রিসিভ করেন শহীদুল্লাহ খান বাদল। ওখানে পৌঁছে প্রথমে বটতলাস্থ সিপিএম অফিসে গিয়ে মেনন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে চলে যাই দুই নাম্বার সেক্টরে। খালেদ মোশাররফ ছিলেন সেক্টর কমান্ডার।অনেক রোমাঞ্চকর অপারেশনের মধ্য থেকে সংক্ষেপে কয়েকটি শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানের ঘটনা বর্ণনা করছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের কাছে বিমান বাহিনীর একটি রিক্রুটিং অফিস ছিল। এর সামান্য পূর্বদিকে বাবুপুরা পুলিশ ফাঁড়ি। পরিকল্পনা মতো আমি, লস্কর ও সুফি একটি বেবি টেক্সিতে ব্যাগ ভর্তি ২০ পাউন্ড বিস্ফোরকসহ সেখানে যাই। সিদ্ধান্ত ছিল লস্কর ভেন্টিলেটর দিয়ে বিস্ফোরক যথাস্থানে রেখে আসবে, সুফি ও আমি গাড়িতে বসে কভার দেবো। লস্কর বেচারা ছিলেন আমার মতো খাটো, ভেন্টিলেটরের নাগাল পেতে তার খুব অসুবিধা হচ্ছিল। অবস্থা দেখে সুফি এগিয়ে গিয়ে তাকে সাহায্য করে। আমি ব্যাগের মধ্যে স্টেনগান নিয়ে বেবিটেক্সিতে বসেছিলাম, ড্রাইভার বিষয়টি বুঝতে পেরে বিচলিত হয়ে ওঠে। আমি তাকে ধমক দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করি। স্কুটার নিয়ে মেডিকেল কলেজের বর্তমান এমার্জেন্সি গেটে আসতেই বিস্ফোরণের পুরো এলাকা ধোয়া ও ধুলায় অন্ধকার হয়ে যায়। আমরা ওখানেই বেবিটেক্সি ছেড়ে মেডিকেল কলেজের ভেতরে ঢুকে আবার পশ্চিমদিকের গেট দিয়ে বেরিয়ে রিকশা নিয়ে বুয়েটের হলে চলে যাই।
সে হলেই থাকতো সঙ্গী লস্কর। ওর রুমে ঢুকে দ্রুত কাপড় বদলে ফিরে যাই ঘটনাস্থলের কাছাকাছি। সেখানে পৌঁছে দেখি হুলুস্থূল অবস্থা। জনতার সঙ্গে মিশে দূর থেকে ঘটনা দেখছি। আশপাশের এলাকা আর্মি, মিলিটারি পুলিশ, বিমান সেনা ও পুলিশ ঘিরে ফেলেছে এবং নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। তারা আশঙ্কা করছিল আশপাশে কোথাও মাইন পোতা আছে। এ অপারেশনটি মে মাসের শেষের দিকে অথবা জুনের প্রথমে চালিয়েছিলাম। মাওসেতুং বলেছিলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছেন মাছ আর জনগণ জল।’ জল ছাড়া মাছ বাঁচতে পারে না। ঢাকার মানুষ আমাদের মাছের জলের মতোই আশ্রয় দিয়েছিলেন, সহায়তা করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে (নভেম্বর) আমাদের আরেকটি সফল অপারেশন ছিল বিডিয়ারের গেটে। এ অভিযানে অনেক প্রাণহানী হয়েছিল।
ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান দি ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড এখানে সে সময় সার্ভের কাজ করছিল। প্রতিষ্ঠানটির মালিক মজিদ সাহেব ছিল মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষ। এ ঠিকাদার ফার্মটির ইঞ্জিনিয়ার মান্নান এবং ইঞ্জিনিয়ার আনিসুল ইসলাম আমাদের সহায়তা করেন। তাদের সহায়তায় দিনমজুর সেজে পিলখানার অভ্যন্তরে প্রবেশের সুযোগ পেয়ে যাই। দিনমজুরদের যে দলটির সঙ্গে আমি ভেতরে যেতাম সে দলের একজন ছাড়া কেউ আমার আসল পরিচয় জানতো না। একদিন কাদামাটি গায়ে ঝিগাতলার গেট দিয়ে বের হচ্ছি এমন সময় মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন এনএসপিএর তৎকালীন নেতা মাহবুবুল হক দোলন আমাকে চিনে ফেলেন, অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘খোকা না? একী হাল?’ আমার তখন ভয় ও বিব্রতকর অবস্থা। সংক্ষেপে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর দ্রুত মিশে গেলাম জনতার মধ্যে।
এভাবে বেশ কয়েকদিন পিলখানার অভ্যন্তরে প্রবেশের সুযোগ পেয়ে যাই। আমি উত্তেজনা নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পিলখানার অভ্যন্তরের সবকিছু দেখে নিচ্ছি। কোথায় কোথায় অবজার্ভেশন পোস্ট আছে পরখ নেই। যদিও আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল পিলখানার অভ্যন্তরে বিস্ফোরণ ঘটানো। সম্ভব হলে তাদের অস্ত্র ভাণ্ডারের কাছাকাছি। কিন্তু সার্ভের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার ভেতরে বিস্ফোরক নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে আজিমপুর কবরস্থান সংলগ্ন গেট এলাকায় আমরা প্রচন্ড গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তৎকালীন ইপিয়ার বাহিনীর বেশ ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়েছিলাম। রাতে পরিচালিত এ হামলার সময় একটি গুলি দেয়ালে লেগে ডিরেকশন চেঞ্জ হয়ে আমার পায়ে এসে লাগে।
দুদিন পর একটি ক্লিনিকে গিয়ে ওটা অপারেশন করে তুলতে হয়। ঢাকায় আমরা আরো অনেক বড় ধরনের অপারেশন করি, ঢাকায় যুদ্ধরত অন্যগ্রুপগুলোও তটস্থ করে তুলেছিল পাকিস্তানি বাহিনীকে। দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা দখলদারদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।