দ্য পলিটিশিয়ান ।।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব এডভোকেট রুহুল কবির রিজভী আহমেদ একাধিকবার দীর্ঘ সময় কখনো বাধ্য হয়ে কখনো বা স্বেচ্ছায় অবরুদ্ধ ছিলেন নয়া পল্টনে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়।
এ সময় তিনি দিনের পর দিন ২৪ ঘন্টাই কাটাতেন বিএনপি কার্যালয়ের ছোট একটি রুমে। ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে শুরু হওয়া এক অবরুদ্ধ জীবনের শুরুর গল্প তিনি এক লেখায় তুলে ধরেছেন।
কিভাবে শুরু হল রিজভী আহমেদের অবরুদ্ধ জীবন এবং অবরুদ্ধ জীবনের প্রথম রাতের ঘটনা থাকছে আমাদের এই আয়োজনে ” অবরুদ্ধ দিনলিপি ” নামক বইয়ের পাতা থেকে।
রিজভী আহমেদ তার লেখা সেই বইয়ে ২০১২ সালের ১০ই ডিসেম্বর লিখেন, অবরোধ শেষ হলে সন্ধ্যা বেলায় প্রেসব্রিফিং অনুষ্ঠিত হয়। সারাদিনে ঘটনা প্রবাহের বিবরণ পঠিত হয়। পাঠ করেন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। রাত্রি আটটার সময় বাসায় ফিরলাম।
আজ ১০ ডিসেম্বর সকাল নয়টায় বাসা থেকে রওয়ানা দিলাম দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের উদ্দেশ্যে। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন অতিক্রম করার সাথে সাথেই মোবাইলে খবর পেলাম মহাসচিব ও আমার নামে মামলা দায়ের করা হয়েছে, কিন্তু নিশ্চিত হতে পারলাম না। ফার্মগেট সিগন্যালে গাড়ি দাঁড়ানোর সময় একজন মোবাইলে জানালো দলীয় কার্যালয়ের গেটের সামনে দলের নেতা-কর্মী যাকেই পাচ্ছে পুলিশ তাকেই গ্রেফতার করছে।
আরো কিছুদূর এগুতেই শুনলাম মৎস্যজীবী দলের সভাপতি রফিকুল ইসলাম মাহতাবকে দলীয় কার্যালয়ের গেট থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কয়েকজন আমাকে দলীয় কার্যালয়ে না যেতে পরামর্শ দিলো। কিন্তু আমি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়ে দলীয় কার্যালয়ে ঢুকে পড়ি। যদিও আশে পাশে অসংখ্য পোশাকধারী ও সাদা পোষাকের পুলিশ অবস্থান করছিলো।
অফিসের আশপাশে কি পরিবেশ বিরাজ করছে তা জানার জন্য মির্জা আলমগীর সাহেব মোবাইলে আমার সাথে কথা বলেন, আমি তাঁকে আমাদের দুজনের মামলার বিষয়ে অবগত করলাম। তিনি বিজয়নগর মোড়ে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে কয়েকজন রোগী দেখে দলীয় কার্যালয়ে চলে আসেন।
আমাদের দেশের সামষ্টিক রাজনৈতিক চৈতন্য এখনও বিশ্বমান লাভ করেনি। সরকারি দল ও বিরোধী দল যোজন যোজন দূরে অবস্থান করে।ক্ষমতাসীন দল বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দকে ব্যক্তিগত শত্রু মনে করে।
আর এই মানসিকতার কারণে দেশের রাজনীতি উন্নততর রূপ লাভ করছে না। ক্ষমতাসীন মহল বিরোধী দলের সকল কর্মকাণ্ড এবং মতামতকে দুর্বিষহ দমন-পীড়নের মাধ্যমে একেবারে ধ্বংস করে দিতে চায়। প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধই রাজনীতির অপরিহার্য উপাদান হয়ে উঠেছে। একই জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পর প্রতিহিংসার রাজনৈতিক সংস্কৃতি কখনোই দেশকে সমৃদ্ধ, উন্নততর ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে দেবে না।
এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলো কখনোই জাগ্রত হবে না। ফলে কার্যকর রাষ্ট্রের গ্যারান্টি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। আর এইরকম একটি দুর্বল মুহুর্তে আন্তর্জাতিক মুরুব্বিরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। ব্যর্থ রাষ্ট্রের কালিমা লেপন করে নিজেদের প্রভূত্ব বিস্তার অনিবার্য করে তোলে।
তারপরেও তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিকদেও চৈতন্যোদয় হয়নি। আত্মসর্বস্ব, ব্যক্তিগত লোভ, দেশপ্রেম বিবর্জিত ব্যক্তিরাই রাজনৈতিক প্রাঙ্গন মুখর করে আছে বলেই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান কার্যকর ও শক্তিশালী হওয়ার জন্য একটি ধারাবাহিক অনুশীলনের ঐতিহ্য এখনো এদেশে স্থাপিত হয়নি ।
মহাসচিব কার্যালয়ে ঢোকার পরপরই গেটের সামনে পুলিশের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। আজ সন্ধ্যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপ-সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি. ব্লেক দলের চেয়ারপার্সনের সাথে গুলশানস্থ কার্যালয়ে সাক্ষাতে দলের মহাসচিবকেও উপস্থিত থাকতে হবে। কিন্তু পুলিশের গতিবিধি রহস্যজনক। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যার কাছাকাছি সময়ে মির্জা আলমগীর গুলশান কার্যালয়ের দিকে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হলেন। তাঁকে বিদায় দিয়ে নিজের রুমে এসে চেয়ারে বসার সাথে সাথেই খবর পেলাম মহাসচিবকে আটক করে পুলিশ গাড়িতে তুলে নিয়েছে।
তাঁকে গ্রেফতার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। পুলিশের এই অগণতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদে রাত্রি সাড়ে সাতটার সময় আমি আমানউল্লাহ আমান ও আবদুস সালাম এর উপস্থিতিতে তাৎক্ষাণিকভাবে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে একটা সংবাদ বিবৃতি পাঠ করি । রাত বাড়ার সাথে সাথেই অপেক্ষমান সব নেতারা চলে গেলেন। কি করব, ভেবে পাচ্ছি না। বাইরে বেরুলেই নির্ঘাৎ গ্রেফতার।
একবার মনে হলো, গুলশানে আমার এক আত্মীয়ের বাসায় আত্মগোপন করি। কিন্তু হঠাৎ শুনতে পেলাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাকি হুমকি দিয়েছেন প্রয়োজনে কার্যালয়ে ঢুকেও পুলিশ গ্রেফতার করবে। এই হুমকিতে আমার মধ্যে একটা দৃঢ়তা জন্ম নিলো, নাহ! আমি যাবো না, যত বিপদই আসুক । পরের দিন হরতাল, তাই কার্যালয়ে থাকতে হবে। কিন্তু কতদিন থাকতে হবে জানি না । রাত নয়টার দিকে কার্যালয়ে থেকে যাওয়া নেতৃবৃন্দ বিশ্রামের বন্দোবস্ত করতে লাগলেন।
রাত্রি বারোটা বেজে গেল। সবাই গভীর নিদ্রামগ্ন। আমি মহাসচিবের বাথরুমটা ব্যবহারের জন্য যেতেই একটা সাদা বিড়াল ব্রিফিং রুমটা অতিক্রম করে চলে গেল। আমি এর আগে আমাদের এই কার্যালয়ে কোন রঙেরই বিড়ালের আনাগোনা দেখিনি। কিন্তু আজকের এই ছুটন্ত বিড়ালটি অশুভ কিছুর প্রতীক কিনা বলতে পারবো না।
তবে অফিসে আজ কিছু সংখ্যক মানুষ না থাকলে বিড়ালটিকে দেখে চমকে ওঠা আমার জন্য অস্বাভাবিক হতো না। মনে হলো বিড়ালটি নিঃসঙ্গ নয়-কোথাও একটা যোগসূত্র আছে। এই ভবনসহ আশপাশের ভবনের অনেক খবর সে রাখে। সে এক অনাদিকালের বার্তা বাহক ।