ফিরে দেখা: জাতীয় প্রেসক্লাবে ২৫ ঘণ্টার উত্তেজনা ও মির্জা ফখরুলের গ্রেপ্তার

প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারি ২০২৫ ১১:৫৪ পূর্বাহ্ণ
প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারি ২০২৫ ১১:৫৪ পূর্বাহ্ণ

দ্য পলিটিশিয়ান রিপোর্ট :

২০১৫ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল জাতীয় প্রেসক্লাবকে কেন্দ্র করে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের অবস্থান, সরকার-সমর্থক ও বিরোধীপন্থী সাংবাদিকদের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর গ্রেপ্তার—সব মিলিয়ে ঘটনাটি দীর্ঘ ২৫ ঘণ্টা ধরে চলা এক নাটকীয় উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল।

প্রেসক্লাবে আশ্রয় ও উত্তেজনার সূত্রপাত

৫ জানুয়ারি বিকেলে বিএনপি ও সরকারবিরোধী পেশাজীবীদের ব্যানারে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে প্রেসক্লাবে আসেন মির্জা ফখরুল। রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সেদিন রাত তিনি প্রেসক্লাবেই অবস্থান করেন। তবে এ ঘটনায় সরকারপন্থী সাংবাদিকরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান। তারা প্রেসক্লাবকে রাজনৈতিক আশ্রয়স্থল বানানোর অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ করে এবং ফখরুলকে বহিরাগত আখ্যা দিয়ে তাঁকে ক্লাব ছাড়তে বলেন।

পরদিন, ৬ জানুয়ারি সকাল থেকেই প্রেসক্লাবের সামনে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগসহ সরকার-সমর্থক সংগঠনগুলো ফটকে বিক্ষোভ করে এবং ফখরুলকে বের করে দেওয়ার দাবি জানায়। একপর্যায়ে তারা ক্লাবের মূল ফটক ধাক্কা দিয়ে খোলার চেষ্টা করে। অন্যদিকে, আওয়ামীপন্থী সাংবাদিক নেতারাও ফখরুলের অবস্থানের বিরোধিতা করেন এবং প্রেসক্লাব থেকে ‘বহিরাগতদের’ বের করে দিতে ক্লাব কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানান।

সংবাদ সম্মেলন ও গ্রেপ্তার

বিকেলে বিএনপি-সমর্থিত সাংবাদিকরা পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করেন, যেখানে মির্জা ফখরুলও বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত নিরাপত্তার স্বার্থেই তিনি প্রেসক্লাব ছেড়ে যেতে পারেননি। কিন্তু বিকেল চারটার দিকে তিনি যখন প্রেসক্লাব ত্যাগ করেন, তখন মূল ফটকের সামনে অপেক্ষমাণ পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

গ্রেপ্তারের মুহূর্তটিও ছিল উত্তেজনাপূর্ণ। দলীয় নেতাকর্মী ও সাংবাদিকদের প্রচণ্ড ভিড়ে পুলিশ সরাসরি গাড়ির দরজা খুলতে পারছিল না। পরে ডিবি সদস্যরা তাঁর গাড়িতে উঠে তাঁকে নিয়ে যান মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে। এ সময় সরকারপন্থী কিছু ব্যক্তি তাঁকে ‘খুনি’, ‘রাজাকার’ বলে গালাগালি করে এবং তাঁর গাড়িতে লাথি মারে।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও হরতাল

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এক বিবৃতিতে মির্জা ফখরুলের গ্রেপ্তারকে ‘ফ্যাসিবাদী সরকারের দমন-পীড়ন’ আখ্যা দেন এবং তাঁর নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানান। এরই মধ্যে ঠাকুরগাঁও ও গাইবান্ধায় স্থানীয় বিএনপি সংগঠনগুলো হরতালের ডাক দেয়।

আদালতে জামিন আবেদন

মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে পল্টন ও মতিঝিল থানায় নাশকতার অভিযোগে একাধিক মামলা ছিল। তাঁর আইনজীবীরা জামিন আবেদন করলেও তিনি আদালতে উপস্থিত হতে না পারায় শুনানি হয়নি।

প্রেসক্লাব বিতর্ক

এই ঘটনার পর প্রেসক্লাবের রাজনৈতিক ব্যবহারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সরকারপন্থী সাংবাদিক সংগঠনের নেতারা প্রেসক্লাবকে ‘রাজনীতির আস্তানা’ বানানোর চেষ্টার নিন্দা করেন। অন্যদিকে বিএনপি-সমর্থিত সাংবাদিকরা প্রেসক্লাবে মির্জা ফখরুলের সঙ্গে ‘অশোভন আচরণ’ ও তাঁর গ্রেপ্তারকে ‘গণতন্ত্র বিরোধী কর্মকাণ্ড’ বলে মন্তব্য করেন।

ফিরে দেখা: এক উত্তপ্ত অধ্যায়

আজকের প্রেক্ষাপটে ফিরে তাকালে বোঝা যায়, ২০১৫ সালের এই ঘটনা শুধুই বিএনপির তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের গ্রেপ্তারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি ছিল দেশের তৎকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতার একটি প্রতিফলন, যেখানে গণমাধ্যম, পেশাজীবী সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ বিভাজন স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিল। জাতীয় প্রেসক্লাব, যা মূলত সাংবাদিকদের পেশাগত প্রতিষ্ঠান, তখন রাজনৈতিক সংঘাতের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছিল।

এক দশকের কাছাকাছি সময় পরও বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে জাতীয় প্রেসক্লাবের ভূমিকা এবং রাজনৈতিক নেতাদের নিরাপত্তার প্রশ্নটি একইভাবে প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে।