ভোটের রাজনীতি: ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক গাঢ় হচ্ছে

প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২৫ ০৭:৩৬ অপরাহ্ণ
প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২৫ ০৭:৩৬ অপরাহ্ণ

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মেরুকরণ দেখা যাচ্ছে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। বিএনপি প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর দ্রুত নির্বাচনের দাবি তুলছে, অন্যদিকে জামায়াত ইসলামপন্থি দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে একাধিক বৈঠকে জাতীয় ঐক্যের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকায় ‘ইসলামি দলগুলোর কদর বাড়ছে বিএনপি জামায়াতে’ শিরোনামে একটি সংবাদ মঙ্গলবার(২৮জানুয়ারি) প্রকাশিত হয়েছে।
নিচে পুরো সংবাদটি দেয়া হলো:
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসলামি দলগুলোকে কাছে টানার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এর অংশ হিসেবে গত ২২ জানুয়ারি রাজধানীতে খেলাফত মজলিসের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি নেতারা। একইদিন বরিশালে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি রেজাউল করীমের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান।

বৈঠকের বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিএনপি নেতারা বলছেন, ন্যূনতম সংস্কার শেষে নির্বাচনের দাবিতে ঐকমত্য সৃষ্টিতে ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছেন তারা। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা বলছেন, তারা চাইছেন অন্য ইসলামি দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করতে।

গতকাল সোমবার রাজধানীর পুরানা পল্টনে ইসলামী আন্দোলনের কার্যালয়ে দলটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপি নেতারা। শেষে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীমের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবদিকদের বলেন, ‘প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন আদায়ের বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া দশটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে।’ অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি রেজাউল করীম বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলমান থাকবে। নির্বাচনের বিষয়েও বিএনপির সঙ্গে ঐকমত্য হয়েছে।’
দুপুর ১২টা থেকে প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক শেষে আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ রেজাউল করীম বলেন, ‘দেশ, মানবতা ও রাজনীতির ব্যাপারে বিএনপি মহাসচিব আপনাদের (গণমাধ্যমে) সামনে উপস্থাপন করেছেন। এগুলো নিয়ে আমাদেরও একই কথা।’ নির্বাচনের সূচির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা আমরা আগের থেকেই বলেছি যে, দ্রুত সময়ে আমরা যে শব্দটা ব্যবহার করেছি যে, খুব বেশি সময় না নিয়ে যৌক্তিক। সেই যৌক্তিক সময়টা আমরা বলেছি, এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে। এরকম একটা কথা আমরা বলেছি। আর ছয় মাস তো প্রায় চলেই গেল; আর এক বছরের মধ্যেই সুন্দর একটা জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে সরকার এটাই মূলত আমাদের কথা। আমাদের দুই দলের মধ্যে আলোচনা ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকবে।’
বিএনপি ও ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের বৈঠকে যে ১০টি বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেগুলো হলো ১. আধিপত্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদমুক্ত স্বাধীন সার্বভৌম টেকসই গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা। ২. দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, খুনি ও টাকা পাচারকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। ৩. ভোটাধিকারসহ সব মানবাধিকার রক্ষায় জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলা। ৪. ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। ৫. দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ এবং সব অধিকারবঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা এবং আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক করে নিয়ে আসা। ৬. আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী সব শক্তি দেশ পুনর্গঠনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব। ৭. ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে আঘাত করে কথা বলব না। ৮. ভবিষ্যতে যাতে আওয়ামী লীগের মতো আর কোনো ফ্যাসিবাদী শক্তি ক্ষমতায় আসতে না পারে, সে ব্যাপারে আমরা রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকব। ৯. ইসলামি শরিয়াহবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত নেব না এবং ইসলামবিরোধী কোনো কথা কেউ বলব না। ১০. প্রশাসনে এখনো বিদ্যমান আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসরদের দ্রুত অপসারণ করা।
বৈঠকে মির্জা ফখরুল ছাড়াও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম, মহাসচিব ইউনুছ আহমেদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী, আশরাফ আলী আকন, মাহবুবুর রহমান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান, দপ্তর সম্পাদক লোকমান হোসাইন জাফরী বৈঠকে অংশ নেন।
এরই মধ্যে গতকাল রাতে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। রাত ৮টা ৪০ মিনিটে শুরু হয়ে ১০টা ২০ মিনিটে বৈঠক শেষ হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকে অনলাইনে সংযুক্ত হয়ে এ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, বৈঠকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তার আলোচনার বিষয়বস্তু তুলে ধরেন। এ সময় তারেক রহমান অন্য ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে পর্যায়ক্রমে বৈঠকের জন্য বিএনপি মহাসচিবকে নির্দেশনা দেন।
বৈঠকে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, বেগম সেলিমা রহমান ও হাফিজ উদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে গত ২১ জানুয়ারি বরিশালে ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের (চরমোনাই পীর) সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান। বৈঠক শেষে সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেছিলেন, ‘তারা চাইছেন আগামী নির্বাচনে ‘ইসলামভিত্তিক দলগুলোর যেন একটি বাক্স থাকে। নিজেদের মধ্যে মত পার্থক্য ভুলে আমরা চাইছি আমাদের ভোট যেন সামনে আর ভাগাভাগি না হয়।’
ইসলামী দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জামায়াত অন্য ইসলামী দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে জোট করার চেষ্টা করছে। এর অংশ হিসেবে গত ২২ জানুয়ারি দলের আমির ডা. শফিকুর রহমান বরিশালের চরমোনাইয়ে গিয়ে চরমোনাই পীর হিসেবে পরিচিত ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। তাদের এই সাক্ষাতের পর ইসলাম ধর্মভিত্তিক দলগুলোর নির্বাচনী জোটের বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত হচ্ছে। তারা মনে করেন জামায়াতসহ কয়েকটি ইসলামপন্থি দলের নিজস্ব একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে, যারা পরিস্থিতি অনুযায়ী কিছুটা প্রভাবও তৈরি করতে পারে। সেটিই তাদের ‘ভোটের জোটে’ উদ্বুদ্ধ করেছে বলে ধারণা করা হয়।
ইসলামী আন্দোলনের আমিরের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ গণমাধ্যমকে বলেন, অন্য ইসলামী দলগুলোর মধ্যে আলোচনার প্রক্রিয়া চলছে। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলেই এর একটি রূপ দেখা যাবে।
বৈঠকের বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলছেন, ‘জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতাদের সৌজন্য সাক্ষাৎ এই আভাসই দিয়েছে যে তাদের মধ্যে দূরত্ব কমছে। মনে হচ্ছে তারা একটি নির্বাচনী ঐক্যের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত তারা সেটি পারেন কি না।’
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ইসলামি দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চাই। এজন্য আমরা ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছি। বিএনপি কী কারণে করছে, সেটা তারাই বলতে পারবে।’

হেফাজতের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক : গত ২২ জানুয়ারি গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে খেলাফত মজলিসের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি নেতারা। বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আর খেলাফত মজলিসের পক্ষ থেকে দলের আমির মাওলানা আবদুল বাছিত আজাদ এবং মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক সম্পর্কে বিএনপি নেতারা বলেন, ‘বৈঠকটি সৌজন্যমূলক ছিল। নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের অংশ হিসেবে এ বৈঠক। বৈঠকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে, যেমন ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করার প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ অব্যাহত রাখা। এছাড়া দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, ইসলামি মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার বিষয়েও আলোচনা হয়েছে।’ তারা বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং বিএনপির আগের রাজনৈতিক জোটের প্রসঙ্গও আলোচনা করা হয়। বিএনপির পক্ষ থেকে এসব দলের সঙ্গে আরও বৈঠক এবং আলোচনা হতে পারে বলে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।