উত্তরের জনপদে দুই নেত্রী: মোনাজাতউদ্দিনের অভিজ্ঞতা

প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২৫ ১১:৪৭ অপরাহ্ণ
প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২৫ ১১:৪৭ অপরাহ্ণ

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জনসংযোগমূলক সফর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া উত্তরাঞ্চলে এমনই এক সফরে যান, যেখানে তিনি প্রত্যন্ত এলাকার জনগণের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন, আন্দোলনের প্রতি তাঁদের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করেন। এ সফরে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের।

মোনাজাতউদ্দিন তার লেখা বই ‘পথ থেকে পথে’ এর ”দুই নেত্রীর সঙ্গে” সে সফরের স্মৃতিকথা।
লেখাটি শুধু দুই নেত্রীর সফরের বিবরণই নয়, বরং রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সেসময়ের সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, জনমানসের প্রতিক্রিয়া এবং নেতাদের জনসাধারণের সঙ্গে সম্পর্কের একটি জীবন্ত চিত্র তুলে ধরে।
নিচে হুবহু বই থেকে তাঁর লেখাটি তুলে ধরা হলো:

দুই নেত্রীর সঙ্গে

ফেব্রুয়ারির তিন তারিখ ।
যাবার কথা দিনাজপুরে। দিনাজপুর থেকে ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, বোদা, তেঁতুলিয়া। গোছগাছ শেষ, বাস ধরব ভোরে, মধ্যরাতে একজন বিএনপি কর্মী খবর দিয়ে গেল : খালেদা জিয়া আজ রাতে রংপুরে এসে পৌঁছেছেন, তিনি খোঁজ নিতে বলেছেন আমি রংপুরে আছি কি না। থাকলে যেন সকাল আটটার আগেই সার্কিট হাউসে দেখা করি ।
ব্যাগ গোছানোই থাকল, দিনাজপুরের সফর বাতিল । বাসস্ট্যান্ডে যাবার বদলে পরদিন সকাল সাড়ে সাতটায় সার্কিট হাউসে। প্রথমেই ফরিদা হাসানের সাথে দেখা, তিনি বললেন, ম্যাডাম নাকি বেশ কয়েকবার বলেছেন আমার কথা : এবারের উত্তরাঞ্চল সফরের অধিকাংশ মিটিং হবে প্রত্যন্ত এলাকায়, সেখানে সংবাদের স্থানীয় প্রতিনিধি কেউ আছে কি না ঠিক নেই, সেক্ষেত্রে অসুবিধা না থাকলে আমি যেন মিটিংগুলো কভার করি। ফরিদা হাসান বসতে দিলেন তাঁর ঘরে, হাতে দিলেন চায়ের পেয়ালা, আদরের পুরাতন স্বভাবসুলভ কণ্ঠে বললেন, একটুখানি বসো ভাই, ম্যাডাম কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরুবেন, তোমার সাথে কথা বলবেন তিনি। এই বলে নেত্রীর দরজায় টোকা দিলেন তিনি, উচ্চস্বরে জানালেন আমার আসবার কথা। দরজা খুলে গেল, সামনেই বেগম খালেদা জিয়া হালকা ঘিয়ে রঙের শাড়িতে উজ্জ্বল । টেবিলের ওপর থরে থরে সাজানো খাবার, ত্রিকোণ আকৃতির পরোটা, পাতলা রুটি, সবজি, ডিম, মাংস, কমলা। আসুন নাস্তা করি আগে। আপনি আমাদের সাথে যাচ্ছেন তো? আপনাকে রংপুরে পাওয়া যাবে, ভাবিনি। আজ বোনারপাড়ায় মিটিং, চলুন ঘুরে আসি ।
ধন্যবাদ। নাস্তার পর্ব আগেই শেষ করেছি, আর নয়, চলতে পারে শুধু চা। ফরিদা হাসান আরেক প্রস্থ চা তুলে দিলেন হাতে। খেতে খেতে এটা-ওটা আলাপ। এবারের ট্যুরের উদ্দেশ্য জানালেন তিনি : এমন সব এলাকা বেছে নিয়েছেন যেখানে যোগাযোগ-ব্যবস্থা খুব খারাপ, সহজে কোনো নেতা-নেত্রী যেতে পারেন না, সেখানেই যাচ্ছেন বক্তৃতা করতে, লোকজনদের সাথে সরাসরি কথা বলতে। সাধারণ মানুষ কি আন্দোলন সম্পর্কে হতাশ? শহর এলাকায় এইরকম বলা হচ্ছে বটে, কিন্তু বিএনপি নেত্রী সেটা সরেজমিনে যাচাই করে দেখতে চান। সফরের শেষদিনে জনসভা করবেন তিনি রংপুর শহরে, তার আগের দুদিন ঘুরবেন গাইবান্ধার বোনারপাড়া, শাঘাটা, সুন্দরগঞ্জ, দিনাজপুরের হাকিমপুর, হিলি।
অনেকদিন পর খালেদা জিয়ার সাথে দেখা। লক্ষ করলাম আগের তুলনায় অনেক বেশি সহজ হাসিখুশি আর আলাপি তিনি। একসময় ছিল, অন্তত উত্তরাঞ্চলে সফরে এলে দেখেছি, অনেক নেতা তাঁর কামরায় ঢোকা তো দূরের কথা, হঠাৎ করে কথা বলার সাহস পেতেন না তাঁর সাথে। উনিশ-বিশ হলে ধমক খেতেন। অথচ, এখন নেত্রী বিশ্রামের সময়ও স্থানীয় নেতাকর্মীদের সাক্ষাৎ দিচ্ছেন, খুব হাসিখুশি মেজাজে কথা বলছেন। দুপুরের খাবার বিকেলে, রাতের খাওয়া এগারো বারোটায়। বিশ্রামের সময়টুকু আগের মতো বাঁধা নেই। পথে যেতে গাড়ি থামিয়ে সরাসরি কথা বলছেন রাস্তার দুপাশে দাঁড়ানো গ্রামের নারী- পুরুষদের সাথে। গেলেন যেদিন দিনাজপুরের হিলি এলাকায়, ছিল জনসভা, খালেদা জিয়া উৎকুন্নভাবে হেঁটে গেলেন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত লাইন পর্যন্ত সরাসরি হাত মেলালেন ভারতীয় এলাকার মেয়েদের সাথে। মেয়েরা তো “দিদি, দিদি’ বলতে অস্থির। ‘দিদি আসুন বসুন চা খান’ বলতে বলতে আসন নিয়ে এলেন ভারতীয় এলাকার সিঁদুর-পরা গৃহবধূরা। খালেদা জিয়া বসলেন না, কিন্তু খুব হাসিখুশির সাথে কুশল বিনিময় করলেন, বললেন, ‘যে-কোনো মূল্যে আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে।’ তিনি হাতব্যাগ থেকে বের করলেন লজেন্স, বেঁটে দিলেন শিশু-কিশোরদের মধ্যে। বিএসএফ সদস্যরা হতবাক, তাঁরা দুহাত বুকে কিংবা কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার জানালেন খালেদা জিয়াকে, বিনিময়ে নেত্রী হাত কপালে তুলে জানালেন সালাম ।
খালেদা জিয়ার এইরকম সীমান্তসফর মনে করিয়ে দিল শেখ হাসিনার তেঁতুলিয়া সফরের কথা। সেটা বোধকরি ‘৮৬ কি ‘৮৭ সাল, নওগাঁ থেকে শুরু হলো আওয়ামী লীগ নেত্রীর উত্তরাঞ্চল সফর। জনসভাগুলো কাভার করার জন্যে আমি সঙ্গে ছিলাম সেবার। নওগাঁ থেকে সড়কপথে বগুড়া-রংপুর হয়ে ঠাকুরগাঁও, তারপর পঞ্চগড়-তেঁতুলিয়া। তেঁতুলিয়ায় জনসভার আগে শেখ হাসিনা হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলেন বাংলাবান্ধা এলাকাটা দেখতে যাবেন তিনি । বাংলাদেশের মানচিত্রে খাড়াখাড়ি উপরে উটের মাথার আকারের যে অংশটুকু, সেটাই বাংলাবান্ধা । তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোর পাশ দিয়ে সড়কটি চলে গেছে প্রায় ১২ মাইল । কিছুটা সুড়কি-ঢালা, কিছুটা মাটির। শেখ হাসিনা বি. ডি. আর. চেকপোস্ট ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলেন আরও ভেতরে, একেবারে নো ম্যান্স ল্যান্ডে। নেত্রীকে দেখে লোকজন অভিভূত, দূরের বাড়ি থেকে ছুটে এসে আন্তরিকভাবে শুভেচ্ছা জানালেন। বিএসএফ সদস্যরা হাত নেড়ে সালাম জানালেন। বি. ডি. আর সদস্যরা দিলেন স্যালুট । শেখ হাসিনা সে-সময় সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী।
সেদিন খুব উৎফুল্ল মেজাজে ছিলেন শেখ হাসিনা, মাঝে মাঝে হালকা কৌতুক করছিলেন, গাড়িতে বসেই একের পর এক ছবি তুলছিলেন ছোট্ট ক্যামেরায় । একটা ব্যাপার মনে পড়ে, বাংলাবান্ধার সীমান্তসফরের সময় কোত্থেকে যেন এসে জুটলেন এলাকার একজন জনপ্রতিনিধি। আগে আওয়ামী লীগে ছিলেন, এখন (সফর-সময়ে) সরকারি দলের সদস্য। সীমান্ত এলাকায় হেঁটে বেড়ানোর সময় জনপ্রতিনিধিটি খুব বকরবকর করছিলেন। অন্যরা বিরক্ত হলেও ব্যাপারটি কৌতুকের সাথে উপভোগ করছিলেন নেত্রী। জনপ্রতিনিধি নেত্রীর পাশেপাশে ঘোরেন আর আঙুল উঁচিয়ে এটা দেখান, ওটা দেখান। বলেন, ঐ যে ঐ গাছটা, আপা, ওটা ইন্ডিয়ান ।
নেত্রী বলেন, ও তাই নাকি! আচ্ছা!
: ঐ যে মানুষটা, লাঙল চষে, ও হলো ইন্ডিয়ান … ।

নেত্রী বলেন, তাই নাকি! আচ্ছা !
ঐ যে বাড়িগুলো, ঐ যে ঘর, ওগুলো সব ইন্ডিয়ান … ।
: আচ্ছা আচ্ছা! তাই নাকি!
এভাবে জনপ্রতিনিধি নানানটা জিনিস দেখাচ্ছেন, আর শেখ হাসিনা অবাক হবার মতো করে ‘ও আচ্ছা তাই নাকি’ ইত্যাদি বলছেন। এ-সময় হঠাৎ সামনে এলো একটা কুকুর, এসেই ঐ জনপ্রতিনিধির পায়ের কাছে শুঁকতে শুরু করল। শেখ হাসিনা প্রায় লাফিয়ে দুপা সরে এলেন, তারপর আঙুল উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, চেয়ারম্যান সাহেব চেয়ারম্যান সাহেব, এটা কোথাকার কুকুর, ইন্ডিয়ার না বাংলাদেশের?
চেয়ারম্যান সাহেব আর কী বলেন! লজ্জায় সরে গেলেন নেত্রীর পাশ থেকে । আপাতত তাঁর বকবকানি থামল ।
পাঠকগণ, মাফ করবেন, পথ থেকে পথে চলতে অনেক কথা এসে যায়। যেমন খালেদা জিয়ার প্রসঙ্গ বলতে বলতে শেখ হাসিনার সফরে চলে গিয়েছি।
যাই হোক, নাস্তা সেরেই রওনা হলাম আমরা বোনারপাড়ার পথে। সঙ্গে হান্নান শাহ, ফরিদা হাসান, জলিল, রেজাউল হক সরকার রানা ও আরও দুজন। বোনারপাড়া একটি রেলওয়ে জংশন, সেখানে সাধারণত ট্রেনে যাই, গিয়েছি বহুবার, কিন্তু এই প্রথম সড়কপথে এলাম। রংপুর থেকে পলাশবাড়ি হয়ে গাইবান্ধা, সেখান থেকে ১২/১৩ মাইল কাঁচা রাস্তায় যেতে হবে। বিএনপির উত্তরাঞ্চলীয় এলাকার সংগঠক রেজাউল হক সরকার রানা, গাড়িতে বারবার বলছিলেন, রাস্তা কাঁচা হলেও খুব ভালো, পিচের রাস্তাও হার মানবে। কিন্তু পরে বোঝা গেল, হয় তিনি জোক করছিলেন কিংবা নেহায়েত সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। গাইবান্ধা শহর ছাড়িয়ে কিছুটা যেতেই হার-হাড্ডির বাজনা শুরু হয়ে গেল । এর চেয়ে চষাজমির ওপর দিয়ে যাওয়াও বুঝি ভালো ছিল। উঁচু-নিচু, খাদ-গর্ত, ধুলো, ধাক্কা । খালেদা জিয়া বললেন, এমন রাস্তাও দেশে আছে? এরশাদ তা হলে কোথায় উন্নয়ন করল?
বোনারপাড়ার পর জনসভা ছিল গাইবান্ধার অপর এক উপজেলা সুন্দরগঞ্জে। সেখানে আমার যাওয়া হয়নি। পরে শুনলাম, সেখানকার রাস্তা এতই খারাপ যে গাড়ির চাকা কয়েকবার ডেবে গিয়েছিল। সবাইকে বারবার গাড়ি থেকে নামতে হয়, আর গাড়ি ঠেলতে হয় বেগম জিয়া আর ফরিদা হাসান বাদে সবাইকে। একবার খাদ থেকে গাড়ি টেনে তুলতে গ্রামবাসীদের ডেকে আনতে হয়। সুন্দরগঞ্জের রাস্তা সম্পর্কে খালেদা জিয়ার মন্তব্য শোনা হয়নি। তবে মন্তব্য করে থাকলে তা নিশ্চয়ই সুন্দর ছিল না।
আমি দল থেকে পৃথক হয়ে গেলাম। বোনারপাড়া থেকে সুন্দরগঞ্জ যাওয়া হয়নি তা আগেই বলেছি। তার কারণ, হিসেব করে দেখলাম, সুন্দরগঞ্জ থেকে রংপুর শহরে ফিরতে সময় হবে রাত দশ কি এগারোটা, তখন নিউজ ধরানো কষ্টকর হবে। ঠিক করলাম, গাইবান্ধা শহর থেকে জনসভার খবরটি ডেসপ্যাচ দিয়ে আন্তঃনগর ‘তিস্তা’ ধরে রংপুর শহরে ফিরে যাব।

বোনারপাড়ায় দুপুরের খাবার ব্যবস্থা হয়েছিল। শুনলাম খুব বড় মাছ কাটা হয়েছে, আছে খাসি, মুরগি। কিন্তু রান্না হলেই খাওয়া হয় না, খালেদা জিয়া বললেন : এখানে নয় সুন্দরগঞ্জে গিয়ে খাবেন। অতএব উপোস। গাইবান্ধা নেমে হোটেলের ঝাল-মশলা খাবার ইচ্ছে হলো না, কেননা আগামী দুতিনদিন অন্তত বিছানায় পড়া যাবে না ৷
আমি ভাবছি বেলা থাকতেই জনসভার খবরটি পাঠানোর কথা। সন্ধ্যার পর অফিসের টেলিফোন বিজি হয়ে যাবে, লম্বা রিপোর্ট পাঠানো মুশকিল হবে। অন্যদিকে ‘তিস্তা’ গাইবান্ধা স্টেশনে এসে পৌঁছুবে পৌনে পাঁচটায় ।
কিন্তু নিউজ পাঠানোর মতো টেলিফোন পাই কোথায়? গাইবান্ধার ইনকিলাব প্রতিনিধি ছেলেটি পূর্বপরিচিত, একটা নিরিবিলি টেলিফোনের খোঁজে বেরিয়ে
পড়লাম তার সাথে ।

প্রকাশিত- খবরের কাগজ, ১ মার্চ ‘৯০।