[দৈনিক সমকাল এর মতামত বিভাগে প্রকাশিত লেখা থেকে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে]
দ্য পলিটিশিয়ান ডেস্ক :
সমকালীন সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাঙালি জাতির অবস্থান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তাঁর মতে, আমরা কোন সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করব—শোষকের নাকি শোষিতের, সেই সিদ্ধান্তই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
অধ্যাপক চৌধুরী মনে করেন, নিরপেক্ষতা একপ্রকার কপটতা, যা সুবিধাবাদ ও মোনাফেকির পরিচায়ক। নৈতিক বিচারবোধই একজন মানুষকে যোদ্ধায় রূপান্তরিত করে, আর সেই যুদ্ধের জন্য আত্মসম্মানবোধ অপরিহার্য। সমাজে ধর্ম ও বিজ্ঞানের সমন্বয় চাওয়া একপ্রকার বিভ্রান্তি, কারণ পরস্পর বিপরীত সত্যে বিশ্বাস রাখা মূলত কোনো সত্যকেই গ্রহণ না করার নামান্তর।
তিনি আরও বলেন, আধুনিকতার দুটি মূল উপাদান—বৈজ্ঞানিকতা ও আন্তর্জাতিকতা। তবে, বর্তমান বিশ্বায়নপ্রক্রিয়া আদতে আন্তর্জাতিকতার বিপরীত। বিশ্বায়ন যেখানে পুঁজিবাদের বিস্তার ঘটায়, সেখানে আন্তর্জাতিকতা গড়ে তোলে মানবিক সহমর্মিতা ও সহযোগিতার বন্ধন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বিশ্বায়ন বাজার দখল করে, আন্তর্জাতিকতা মানুষের পাশে দাঁড়ায়।”
বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে সমুদ্রপথ ব্যবহারের সুযোগ থাকা জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাঙালির দুর্ভাগ্য যে, তার সামুদ্রিক প্রবেশাধিকার দীর্ঘদিন ধরে বিদেশিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন বাংলা ও ভারতবর্ষকে একত্রিত করলেও, তা মূলত শোষণের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। সামন্তবাদ ও পরাধীনতার বন্ধনে আবদ্ধ বাঙালি তখন ধর্মকে আশ্রয় হিসেবে গ্রহণ করে, যা তার আত্মপরিচয়ের অংশ হয়ে ওঠে।
তিনি পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করেন এবং বলেন, এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই সহজ নয়। একসময় লালন ফকির ও বাউলরা পুঁজিবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, কিন্তু বর্তমান সময়ে তাদের অস্তিত্বও হুমকির মুখে। কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালন ফকিরের আস্তানার ওপর ব্যবসায়িক ও দখলদারিত্বের যে হুমকি এসেছে, তা কেবল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং বিশ্বায়নের ভয়ংকর রূপেরই প্রতিফলন।
অধ্যাপক চৌধুরী মনে করেন, সমাজ বদলের জন্য কেবল বৈজ্ঞানিক চিন্তা যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সংহতি। তবে, তার আগে স্থানীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তিনি বলেন, “যুদ্ধ নেতিবাচক কিছু নয়, এটি ইতিবাচক কর্মকাণ্ড। যুদ্ধের একটি উপাদান আন্তর্জাতিকতা, তবে তার ভিত্তি হতে হবে স্থানীয় ঐক্য।”
এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে অধ্যাপক চৌধুরী একটি বড় প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন—আমরা কোন সংস্কৃতির পক্ষে দাঁড়াব? শোষণের পক্ষে নাকি ন্যায়বিচারের? এই প্রশ্নের উত্তরই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।