ঘোষণাপত্র নিয়ে কথা না শুনলে সমন্বয়কদের পদত্যাগের হুমকি দিয়েছিলেন ড. ইউনূস

প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২৫ ০৬:৫৪ অপরাহ্ণ
প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২৫ ০৬:৫৪ অপরাহ্ণ

দৈনিক আমার দেশ থেকে নেওয়া।।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র নিয়ে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল। রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া ঘোষণাপত্রের বিষয়ে সম্মত ছিলেন না অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি ছাত্রদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, এ ঘোষণা হতে হবে সবার ঐকমত্যে। এটা না মানলে তিনি সরকারে থাকবেন না। উপদেষ্টাদের মধ্যেও এ নিয়ে বিরোধ ছিল। আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল প্রস্তাবিত ঘোষণার ব্যাপারে সরাসরি বিরোধিতা করেন। গুঞ্জন ছিল- এ ইস্যুতে তিন ছাত্রউপদেষ্টা মাহফুজ আলম, নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন। সেনাবাহিনীর মধ্যেও এ নিয়ে ছিল অস্বস্তি।

অবশেষে সোমবার গভীর রাতে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে সরকার, রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠনগুলোর দফায় দফায় আলোচনা হয়। লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গেও তাদের আলোচনা হয়। অবশেষে বিরোধ নিরসন হয়। ছাত্ররা সম্মত হয় যে, ঐকমত্যের ভিত্তিতে তারা জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করবেন ও সুবিধাজনক সময়ে তা ঘোষণা করা হবে।

এ বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা হয়। ছাত্রদের এ ঘোষণা সম্পর্কে বিএনপিসহ মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দেয়। দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা মনে করে, রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করেই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করা উচিত। তা না করে হঠাৎ কোনো ঘোষণা ফ্যাসিবাদবিরোধী পক্ষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করবে। তবে কোনো কোনো দল ছাত্রদের ওই উদ্যোগকে নৈতিকভাবে সমর্থনও জানিয়েছে।

এ নিয়ে গত সোমবার দিনভর রাজনৈতিক ও সুধীমহলে আলোচনার পর রাত পৌনে ৯টায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে প্রেস ব্রিফিং করেন। তাতে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ অংশগ্রহণকারী সব শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দল ও পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্রটি প্রস্তুত করা হবে। এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা জনগণের ঐক্য, ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনা ও রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষাকে সুসংহত রাখার জন্য এ ঘোষণাপত্রটি গৃহীত হবে।

সরকারের এ ঘোষণার পর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। বিষয়টি নিয়ে রাজধানীর বাংলামোটরে বৈঠকে বসেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা।

বৈঠকে উপস্থিত নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৈঠক থেকে রাতে এক পর্যায়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা নিয়ে কথা হয় ছাত্রনেতাদের। তিনি ছাত্রনেতাদের বলেন, জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা সরকার, রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সবাই ঐকমত্যে ভিত্তিতে করা হবে। ছাত্রদের পৃথকভাবে করার দরকার নেই। তার এই কথা না মানলে তিনি সরকারের সঙ্গে আর থাকবেন না- এমন কথা জানালে ছাত্রনেতারা আপাতত ওই ঘোষণা থেকে পিছিয়ে আসে। কর্মসূচিও স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা বলেন, জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা দিলে তার বাস্তবায়নের দায়িত্ব তো পড়বে সরকারের ওপরেই। এখন যদি সরকার রাজনৈতিক দলগুলো ও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে তা ঘোষণা করে এবং বাস্তবায়বন করে, তাহলে তো আর কোনো অসুবিধা নেই।

তবে বৈঠকে উপস্থিত একটি অংশ এতে ক্ষুব্ধ হয়। তারা এই কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নেয়।

বৈঠকে উপস্থিত সূত্র জানায়, ছাত্রদের এই অংশটি কর্মসূচি ঘোষণার পর কেন তা পালন হবে না তা জানতে চান। তারা বলেন, এর আগে রাষ্ট্রপতি অপসারণ, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি তোলা নিয়ে নিজেদের অপরিপক্ষ সিদ্ধান্ত ছিল বলেও মনে করেন। এছাড়াও বর্তমান আন্দোলন ব্যর্থ হলে তাদের সামনের পথচলা আরও কঠিন হবে বলেও মনে করেন তারা।

তারা বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আর সরকার এক নয়। সরকারের ছায়াতলে থেকে কর্মসূচি পালন করতে গেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নিজেদের অস্তিত্ব হারাবে। তাই শেষমেশ ঘোষণাপত্র পাঠ করা না হলেও কর্মসূচি পালন করার সিদ্ধান্ত হয়।

পরে বৈঠক শেষে গত সোমবার রাত পৌনে ২টার দিকে রাজধানীর বাংলামোটরে নিজেদের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জানায় শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ (ঐক্যের জন্য যাত্রা) কর্মসূচি পালন করবে।

এ বিষয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য আরিফুর রহমান তুহিন বলেন, আমাদের উত্থাপিত জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা ও এর বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। আমরা মনে করি, প্রাথমিকভাবে এটা আমাদের বিজয়। কেননা, আমরা ঘোষণা করলেও বাস্তবায়নের দায়িত্ব কিন্তু সরকারকেই নিতে হতো। এ সরকারও আমাদের।

এদিকে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের বিষয়টি নিয়ে গত রোববার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে এ বিষয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরেন এবং উদ্বেগ জানান। সাক্ষাতে ছাত্ররা এককভাবে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র দিলে দেশে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে, সেই শঙ্কার কথা প্রধান উপদেষ্টাকে জানান মির্জা ফখরুল। একই দিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র প্ল্যাটফর্মের নেতারাও ‘ঘোষণাপত্র নিয়ে’বিএনপি মহাসচিবের সাথে সাক্ষাৎ করেন।

গত সোমবার রাতে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে এ ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, বিএনপি স্থায় কমিটি মনে করে, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে মাইনাস করে ‘অরাজকতা’তৈরির চেষ্টা করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ কারণে ছাত্রদের এ প্ল্যাটফর্ম থেকে এর আগে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণের দাবি তোলা হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালের সংবিধান পরিবর্তনের দাবিতে তারা ঢাকায় ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলোকে আমলে না নিয়ে কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্যই তারা এ কাজে অগ্রসর হয়েছে। এছাড়া জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরি করা যে কথা সরকার বলেছে, এর মাধ্যমে সম্ভাব্য একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি থেকে দেশকে রক্ষা করেছে।

ছাত্রদের ঘোষণাপত্র নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এককভাবে কারও সঙ্গে আলোচনা না করে এ ধরনের আয়োজন করতে পারে না। এছাড়া এ মুহূর্তে এ ধরনের ঘোষণাপত্র দেওয়ার বাস্তবতা রয়েছে কি না, সেই প্রশ্নও রয়েছে।

শহীদ মিনারের এ কর্মসূচিতে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরেরও প্রকাশ্য কোনো অবস্থান ছিল না। একইদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিবিরের কেন্দ্রীয় সদস্য সম্মেলন থাকায় সেখানে জামায়াত-শিবির নেতারা ব্যস্ত ছিলেন বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের গণমাধ্যমকে জানান, শহীদ মিনারের এই কর্মসূচিতে আমাদের যাওয়ার সুযোগ নেই।

৩১ ডিসেম্বর ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে ‘প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভ্যুলেশন’ ঘোষণা দেওয়ার কথা ছিল। এতে মূলত, আগামীর নতুন বাংলাদেশের রূপরেখা দেওয়ার কথা জানান তারা। জুলাই বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং নবগঠিত মোর্চা জাতীয় নাগরিক কমিটির যৌথ ‍উদ্যোগে এই ঘোষণাপত্র দেয়ার প্রস্তুতি নেয়।

এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ জানিয়েছিলেন, গণঅভ্যুত্থানকে ঘিরে মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও ৭২-এর সংবিধানকে প্রত্যাখ্যানের দালিলিক প্রমাণ হিসেবে ৩১ ডিসেম্বর জাতির সামনে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করা হবে। এতে মুজিববাদী ’৭২-এর সংবিধানের কবর রচিত হবে।

যদিও সংবিধান সংশোধনের এই উদ্যোগ নিয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন বিএনপি নেতারা। তবে বর্তমান সরকার কী ঘোষণাপত্র দেয়, সেদিকেই এখন নজর সবার। এতে ছাত্রআন্দোলনের নেতাদের চাওয়া কতটুকু পূর্ণ হয় তা দেখার অপেক্ষায় আছেন তারা।

অবশ্য গতকাল শহীদ মিনারের কর্মসূচিতে নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, বাংলাদেশের মানুষ জুলাই ঘোষণাপত্র চায়। তারা সংস্কার চায়, নতুন সংবিধান চায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করার ঘোষণা দিয়েছে, তখন সরকার সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি বিজয়।